চোর সন্দেহে কিশোরকে তিন রাত থানায় আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগ

মাগুরা জেলার মানচিত্র

‘রাতে আমার চোখ বেঁধে বড় বিলের মাঠে নিয়ে যায় পুলিশ। বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে বলে, চুরির কথা স্বীকার না করলে জানে মেরে ফেলবে। আমি জীবন বাঁচাতে মোটরসাইকেল নিয়েছি বলে জানাই।’

মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে পুলিশের হাতে নির্যাতনের শিকার ১৫ বছরের এক কিশোর প্রথম আলোকে এ কথা বলছিল। মাগুরার শ্রীপুর উপজেলায় গত ২১ মে এ ঘটনা ঘটে।

নবম শ্রেণিপড়ুয়া ওই কিশোরের পরিবার জানায়, একটি মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে ২১ মে তাঁদের সন্তানকে প্রথমে এলাকার মাতবরেরা শতাধিক মানুষের সামনে নির্যাতন করেন। পরে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। থানায় তিন রাত আটকে রেখে নির্যাতন চালায় পুলিশ। এরপর ২৪ মে পুরোনো একটি মোটরসাইকেল চুরির মামলায় তাঁকে আদালতে পাঠানো হয়।

তবে ওই কিশোরকে মারধরের অভিযোগ সত্য নয় মন্তব্য করে মাগুরার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁকে বরং পুলিশ চিকিৎসা দিয়েছে। সে পুলিশের কাছে একাধিক মোটরসাইকেল চুরির সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা স্বীকারও করেছে। আগেও সে এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে।

২৪ ঘণ্টার বেশি সময় থানায় আটকে রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সুপার বলেন, ‘এমন হওয়ার কথা নয়। বিষয়টি খতিয়ে দেখব। পুলিশের কোনো সদস্য এর সঙ্গে জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ২১ মে উপজেলার কাজোলী গ্রামে একটি বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে মো. বিপ্লব মল্লিক নামের এক ব্যক্তির একটি মোটরসাইকেল চুরি হয়। সেটি খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে নাজমুল নামের এক ব্যক্তি জানান, ওই কিশোরকে চুরি যাওয়া মোটরসাইকেলটির মতো একটি মোটরসাইকেল চালিয়ে যেতে দেখেছেন তিনি। এরপর ওই কিশোর ও তাঁর অন্য তিন বন্ধুকে হোগলডাঙ্গা গ্রামের মাতবর আবদুল হাই, রাশেদ মোল্লা ও আওয়াল শিকদারের নেতৃত্বে হোগলডাঙ্গা যুব সংঘের সামনে ধরে এনে মারধর করা হয়।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে আবদুল হাই মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মারধর করা হয়নি। পুলিশ উল্টো আমারে ধরে নিয়ে গিছিল, দুজনরে ছাড়ে দিছিলাম বলে। পরে ৫৪ ধারায় আমারে চালান দেয়।’

ওই নির্যাতনের একটি ভিডিও সম্প্রতি প্রথম আলোর এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, শতাধিক মানুষের সামনে ওই কিশোরকে মাটিতে শুইয়ে কেউ শরীর ধরে আছে, কেউ দুই পা চেপে ধরেছে, আবার কেউ টেনে ধরেছে মাথার চুল। এভাবে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হচ্ছে।

ভুক্তভোগী কিশোরের পরিবারের সদস্যরা বলেন, ২১ মে রাতে তাঁদের ছেলেকে শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আবার থানায় আনা হয়। এরপর তিন রাত দুই দিন আটকে রেখে ২৪ মে আদালতে নেওয়া হয়। এর আগে আরও এক দফায় তাঁকে মাগুরা ২৫০ শয্যা হাসপাতালে চিকিৎসা দেয় ডিবি পুলিশ। এরপর ৩০ মে সে জামিনে মুক্তি পায়।

সেদিন সে যে মোটরসাইকেলটি চালিয়েছে, সেটি দিপ্ত নামের তার এক বন্ধুর বলে জানায় ওই কিশোর। ২১ মে থেকে ২৪ মে কী ঘটেছিল—জানতে চাইলে সে বলে, থানায় নিয়ে যাওয়ার পর হাতকড়া পরিয়ে জানালার সঙ্গে ঝুলিয়ে তাকে পেটানো হয়। একপর্যায়ে হাতকড়া পরানো অবস্থায় কবজির মধ্যে রড ঢুকিয়ে চাপ দেওয়া হয়। পরে ডিবি পুলিশ তাঁর ওপর নির্যাতন চালায়।

ভুক্তভোগী কিশোরের মা বলেন, ‘তিন দিন ছেলেটাকে থানায় আটকে রাখা হয়। প্রতিদিন দেখা করতে গেছি, পুলিশ একদিনও দেখা করতে দেয়নি। এখনো ছেলেটা অসুস্থ। কানে ঠিকমতো শুনতে পাচ্ছে না। যা খাচ্ছে পেটে রাখতে পারছে না।’
এলাকার মাতবরেরা চুরি যাওয়া মোটরসাইকেলের টাকা দাবি করছে জানিয়ে ওই কিশোরের বাবা বলেন, তাঁদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে ছেলে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বোনের বাসায় থাকছেন তাঁরা।

জানতে চাইলে চুরি যাওয়া মোটরসাইকেলের মালিক বিপ্লব মল্লিক বলেন, ‘পুলিশকে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়নি। ছেলেটা যেহেতু স্বীকার করেছে, ওর অভিভাবকেরা যদি ক্ষতিপূরণ দেয় তবে নেব।’

এদিকে স্থানীয় ও থানা–পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২১ মে মোটরসাইকেল চুরির ঘটনায় আজ শনিবার পর্যন্ত থানায় কোনো লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়নি। চুরি যাওয়া মোটরসাইকেলটিও উদ্ধার হয়নি। ৫ মার্চ খামারপাড়া গ্রাম থেকে অপর একটি মোটরসাইকেলটি চুরি হয়। এ ঘটনায় ১১ মার্চ শ্রীপুর থানায় মামলা হয়। ওই মামলায় অভিযুক্ত হিসেবে ২৪ মে ওই কিশোরকে আদালতে পাঠানো হয়।

জানতে চাইলে শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রিটন সরকার ঘটনাটি মনে পড়ছে না বলে এড়িয়ে যান। বিস্তারিত জানতে চাইলে থানায় যাওয়ার কথা বলেন তিনি।

ভুক্তভোগী কিশোরের পক্ষে আদালতে শুনানিতে অংশ নেওয়া আইনজীবী রাশেদ মাহমুদ শাহীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই কিশোরের সঙ্গে স্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। আমরা আদালতকে বিষয়টি অবহিত করেছি।’