ছাত্ররাজনীতিই কাল হলো তাকবীরের, অধরাই থাকল মা–বাবার স্বপ্ন

বগুড়ায় নিহত ছাত্রলীগ নেতা তাকবীর ইসলাম খানের মরদেহ মর্গে নিচ্ছেন বন্ধু–স্বজনেরা। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেসোয়েল রানা

‘পরিবারের বড় ছেলে। পড়াশোনা শেষ করে সংসারের দায়িত্ব বুঝে নেবে—এমন স্বপ্ন ছিল। এ জন্য ছেলেকে ভর্তি করাই রাজধানীর বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিবিএ ডিগ্রি শেষও করে। এরপর জড়ায় ছাত্ররাজনীতিতে। পাঁচ বছর আগে সংসারের বদলে দায়িত্ব নেয় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বগুড়া জেলা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে। ছেলের স্বপ্ন ছিল, রাজনীতি করবে। কিন্তু সব স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। ছাত্রলীগ করতে গিয়ে ওই সংগঠনের নেতা-কর্মীর হাতেই প্রাণ দিতে হলো।’

ছাত্রলীগের এক পক্ষের হামলায় নিহত বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তাকবীর ইসলাম খানের (২৭) মৃত্যুর পর বাবা জহুরুল ইসলাম খান বাড়িতে আর্তনাদ করে কাঁদতে কাঁদতে বারবার এসব কথা বলছিলেন। তিনি বলেন, ‘ছাত্ররাজনীতিই কাল হলো ওর। কী অপরাধ ছিল আমার ছেলের? নৃশংস হামলার পর মামলার আসামি গ্রেপ্তার না করে কেন তাকে উল্টো সাজানো মামলার আসামি করা হলো? যে ছেলে জীবনে কখনো অস্ত্র হাতে নেয়নি, তাকে কেন অস্ত্রবাজ প্রমাণের চেষ্টা হলো? ছাত্ররাজনীতি কাদের হাতে—এই প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রীর কাছে, দেশবাসীর কাছে।’

আজ মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে বগুড়া শহরের মালতীনগর দক্ষিণপাড়ার বাসায় গিয়ে ছেলের শোকে কান্নায় ভেঙে পড়া বাবার মুখে এসব কথা শোনা যায়। এ সময় গোটা পরিবারেই চলছিল মাতম। ছেলের শোকে পাগলপ্রায় মা আফরোজা ইসলামও। তিনি ছেলের শোকে বিলাপ করতে গিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন।

আরও পড়ুন

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, পাঁচ দিন ধরে চিকিৎসাধীন থাকার পর আজ দুপুরে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তাকবীর ইসলাম খান মারা যান। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বগুড়া শহরের সাতমাথায় জিলা স্কুলের সামনে ছাত্রলীগের একটি অংশের নেতা-কর্মীদের হামলায় ছুরিকাহত হন তাকবীর। ওই রাতেই তাঁকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক আবদুল ওয়াদুদ প্রথম আলোকে বলেন, তাকবীর ইসলাম খানের মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত করা ছাড়াও ছুরিকাঘাত করা হয়। গত বৃহস্পতিবার রাতে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি ঘটলে গতকাল সোমবার তাঁকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ বেলা ৩টা ১০ মিনিটে তিনি মারা যান।

‘রাজনীতি কেড়ে নিল সন্তান’

তাকবীর ইসলাম খান (২৭)
সংগৃহীত

বাবা জহুরুল ইসলাম বলেন, তিনি ঠিকাদারি ব্যবসা করতেন। বছর দুই ধরে কিডনি রোগে প্রায় শয্যাশায়ী তিনি। তিন ছেলের মধ্যে তাকবীর সবার বড়। অন্য দুই ছেলে তৌফিক ইসলাম ও তৌসিক ইসলাম সরকারি আজিজুল হক কলেজে পড়াশোনা করছেন। বাবা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, তাকবীর শৈশব থেকেই মেধাবী ছিলেন। বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ থেকে ২০০৭ সালে এসএসসি এবং ২০০৯ সালে এইচএসসি পাসের পর ভর্তি হন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউল্যাবে। সেখান থেকে ব্যাচেলর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (বিবিএ) ডিগ্রি অর্জনের পর বগুড়ায় ফিরে ছাত্রলীগে জড়ান।

দল ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার ধুনট উপজেলায় ছাত্রলীগের দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি সমাবেশকে কেন্দ্র করে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। সেখানে ছাত্রলীগের একটি পক্ষের ডাকা বিক্ষোভ সমাবেশে যাওয়ার পথে জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক তাকবীর ইসলাম খানের মোটরসাইকেলে ধাক্কা লাগে জেলা ছাত্রলীগের সদস্য জাহিদ হাসানের মোটরসাইকেলের। এতে দুই নেতার মধ্যে বাগ্‌বিতণ্ডা ও কথা-কাটাকাটি হয়। ধুনট থেকে বগুড়া শহরের সাতমাথায় ফেরার পর ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ বাধে। একপর্যায়ে তাকবীর ইসলাম খানকে ছুরিকাহত করে প্রতিপক্ষরা। গুরুতর আহতাবস্থায় তাঁকে তাৎক্ষণিক শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।

অন্যদিকে ছাত্রলীগ নেতা তাকবীর ইসলাম খানের ওপর হামলার ঘটনায় বগুড়া সদর থানায় গত শনিবার তাঁর মা আফরোজা ইসলাম বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। এ মামলায় বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রউফ, জেলা ছাত্রলীগের সদস্য জাহিদ হাসানসহ সাতজনকে আসামি করা হয়। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও ৩০–৩৫ জনকে মামলায় আসামি করা হয়।

নিজ সংগঠনের প্রতিপক্ষের হামলায় বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক তাকবীর ইসলাম খান পাঁচ দিনের মাথায় হাসপাতালে মারা গেছেন। এর পরপরই বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মর্গে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। আজ মঙ্গলবার বিকেলে
সোয়েল রানা

এজাহারে উল্লেখ করা হয়, বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে তাকবীর ইসলাম খান জিলা স্কুলের প্রধান ফটকের পশ্চিম পাশে বন্ধুদের সঙ্গে চা খাচ্ছিলেন। এ সময় আসামিরা দলবদ্ধ হয়ে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তাঁকে ঘিরে ধরে মাথায় আঘাত ও ছুরিকাহত করেন।

অন্যদিকে ছাত্রলীগের সরকারি আজিজুল কলেজ শাখার কর্মী ও শাজাহানপুর উপজেলার শৈলধুকড়ী গ্রামের বাসিন্দা সোহাগ হোসেন বাদী হয়ে তাকবীর ইসলাম খানসহ ১২ জনের নাম উল্লেখ এবং ২০-২৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে শনিবার থানায় পাল্টা আরেকটি মামলা করেন। তবে পুলিশ দুই মামলাতেই কাউকে গ্রেপ্তার করেনি।

ছাত্রলীগ করতে গিয়েই তাকবীরকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে বাবা জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘ছাত্রলীগ করার অপরাধেই আমার ছেলেকে মেরে ফেলে দিল ওরা? এ কেমন রাজনীতি? পুলিশের কেমন আচরণ। নৃশংস ও বর্বর হামলা হলো ওর ওপর। অথচ পুলিশ ওকেই আসামি করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করল। মরেও শান্তি পেল না ছেলেটা। মিথ্যে মামলার আসামি হয়ে মরতে হলো!’

বগুড়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হুমায়ূন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, গত বৃহস্পতিবার ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মারামারির ঘটনায় শনিবার থানায় পাল্টাপাল্টি মামলা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো মামলায় আসামি গ্রেপ্তার হয়নি।

ব্যবস্থা নেবে ছাত্রলীগ

আজ বিকেলে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেখা যায়, মর্গের সামনে স্বজন ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মাতম চলছে। এ সময় কয়েকজন নেতা-কর্মীকে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায়।

হাসপাতাল চত্বরে বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি রাকিব হাসান সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, সাতমাথায় জনসমক্ষে ছাত্রলীগ নেতা তাকবীর ইসলাম খানের ওপর হামলা করেন সরকারি আজিজুল হক কলেজ শাখার নেতা আবদুর রউফ ও তাঁর সমর্থকেরা। পুলিশ হামলাকারীদের গ্রেপ্তার না করে উল্টো রউফের পক্ষ নিয়ে তাকবীরের বিরুদ্ধে একটি সাজানো মামলা নিয়েছে।

হাসপাতাল চত্বরে বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এ কে এম আসাদুর রহমান বলেন, তুচ্ছ ঘটনার জেরে তাকবীরের ওপর অতর্কিত হামলা করা হয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কোনো বিবৃতি দেয়নি, প্রতিবাদ করেনি, তাঁর সুচিকিৎসায় ব্যর্থ হয়েছে। উল্টো হামলাকারীরা প্রকাশ্য ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

আসাদুর রহমান বলেন, জেলা ছাত্রলীগের কমিটি অনেক আগেই মেয়াদোত্তীর্ণ। তাকবীর হত্যার দায় কোনোভাবেই তারা এড়াতে পারে না। ছাত্রলীগের নেতৃত্ব অযোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। সম্মেলন ঠিক সময়ে হলে এই হত্যাকাণ্ড ঘটত না। আগামী সম্মেলনে তাকবীরও প্রার্থী, রউফও প্রার্থী।

ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা জানান, ২০১৫ সালের ৭ মে জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন হয়। ২০১৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ পান তাকবীর। আগামী সম্মেলনে সভাপতি পদপ্রত্যাশী ছিলেন তিনি।

বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক অসীম কুমার রায় বলেন, তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে ছাত্রলীগ নেতা তাকবীরকে ছুরিকাহত করার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। এ ঘটনায় কলেজ ছাত্রলীগ নেতা আবদুর রউফের সংশ্লিষ্টতা মিলেছে। তাঁর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে সুপারিশও পাঠানো হয়েছে।