ছিলেন ‘মানিকজোড়’, মৃত্যু-দাফনও একসঙ্গে

সম্পর্কে দূরসম্পর্কের চাচা-ভাতিজা কৃষক ইসমে আজম ও আমিনুল ইসলাম। কাছাকাছি বয়সের কারণে তাঁদের সম্পর্কটা ছিল বন্ধুর মতো। এই বন্ধুত্ব এতটাই প্রগাঢ় ছিল যে, একজন আরেকজনকে ছেড়ে ভালো খাবার খেতেন না। তাঁরা বাইরে কোথাও গেলেও একসঙ্গেই যেতেন। এসব কারণে এলাকাবাসীর চোখে তাঁরা ছিলেন মানিকজোড়ের মতো। শেষ পরিণতিটাও হলো তেমনই।

গতকাল সোমবার তাঁরা ট্রাকচাপায় মারা গেছেন একসঙ্গে। এরপর আজ মঙ্গলবার সকালে জানাজা শেষে পাশাপাশি দাফন করা হয়েছে।

ইসমে আজম (৩৮) ও আমিনুল ইসলামের (৩৬) বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের শেখপাড়া গ্রামে। জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার চেংমারী এলাকায় ট্রাকচাপায় তাঁরা নিহত হন। একই সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ওই গ্রামের কৃষক জাকারিয়া (৩৬) ও নিমাই চন্দ্র (৩২)। তাঁরা রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পুলিশ ট্রাকটি জব্দ করেছে।

পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী ও পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, সোমবার দুপুরে কৃষক আমিনুল ইসলাম, ইসমে আজম ও জাকারিয়া ধানের বীজ বিক্রি করতে মোটরসাইকেলে করে বদরগঞ্জ হাটে যান। বীজ বিক্রি করে সন্ধ্যার দিকে তাঁরা মোটরসাইকেলে করে আবার তারাগঞ্জে ফিরছিলেন। পথে আমিনুলের অপর বন্ধু নিমাই চন্দ্রের সঙ্গে দেখা হয়। তাঁকেও মোটরসাইকেলে তুলে নেওয়া হয়। বদরগঞ্জ উপজেলার চেংমারী এলাকায় মোটরসাইকেলটিকে ধাক্কা দেয় একটি যাত্রীবাহী বাস। এতে সবাই মোটরসাইকেল থেকে সড়কের ওপরে ছিটকে পড়েন। এ সময় বিপরীত দিক থেকে আসা দ্রুতগতির পাটবোঝাই একটি ট্রাক (ঢাকা মেট্রো-ট ১৩-৩০৯৭) ওই চারজনকে চাপা দেয়।

মোটরসাইকেলের চালকের আসনে থাকা ইসমে আজম ঘটনাস্থলেই মারা যান। আহত অবস্থায় অপর তিনজনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার রাত ১১টার দিকে মারা যান আমিনুল ইসলাম। অপর দুই কৃষক এখনো চিকিৎসাধীন।

মানুষের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকে। কিন্তু কৃষক ইসমে আজম ও আমিনুল ইসলামের মধ্যে জীবদ্দশায় যে সুমধুর সম্পর্ক দেখেছি, তা ছিল বিরল। তাঁদের খাওয়া, ঘোরাঘুরি, মৃত্যু ও দাফন—সব হয়েছে একই সঙ্গে। আর তাঁদের হঠাৎ মৃত্যুতে পরিবার দুটি অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।
মহিউদ্দিন আজম, সয়ার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান

আমিনুল ইসলাম ও ইসমে আজমের মরদেহ তারাগঞ্জের শেখপাড়া গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হয়। মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে একসঙ্গে জানাজা শেষে লাশ দুটি কবরস্থানে পাশাপাশি দাফন করা হয়েছে।


সয়ার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আজম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকে। কিন্তু কৃষক ইসমে আজম ও আমিনুল ইসলামের মধ্যে জীবদ্দশায় যে সুমধুর সম্পর্ক দেখেছি, তা ছিল বিরল। তাঁদের খাওয়া, ঘোরাঘুরি, মৃত্যু ও দাফন—সব হয়েছে একই সঙ্গে। আর তাঁদের হঠাৎ মৃত্যুতে পরিবার দুটি অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।’

আজ দুপুরে ইসমে আজমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর স্ত্রী নুরেজা বেগম নির্বাক হয়ে বসে আছেন। কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি যেন তাঁর শেষ হয়ে গেছে। পাশে বসেছিলেন প্রতিবেশী একজন। তাঁর কোলে ছিল ইসমে আজমের পাঁচ মাস বয়সী মেয়েসন্তান। তাঁর অপর সন্তান নাহিদ হোসেনের বয়স ছয় বছর।

আমিনুল স্ত্রী ও ছয় বছরের একটি শিশুসন্তান রেখে গেছেন। আর ইসমে আজমের রয়েছে স্ত্রী ও দুটি সন্তান। আজ দুপুরে ইসমে আজমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর স্ত্রী নুরেজা বেগম নির্বাক হয়ে বসে আছেন। কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি যেন তাঁর শেষ হয়ে গেছে। পাশে বসেছিলেন প্রতিবেশী একজন। তাঁর কোলে ছিল ইসমে আজমের পাঁচ মাস বয়সী মেয়েসন্তান। তাঁর অপর সন্তান নাহিদ হোসেনের বয়স ছয় বছর।

নিহত আমিনুল ইসলামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর স্ত্রী রুবিনা খাতুন স্বামীকে হারিয়ে বুক চাপড়ে কাঁদছেন। পাশেই ছিল ছয় বছর বয়সী সন্তান রবিউল ইসলাম।

প্রতিবেশী নজরুল ইসলাম বলেন, নিহত ইসমে আজমের কিছুটা আর্থিক সংগতি থাকলেও আমিনুলের তা নেই। আমিনুলের রয়েছে মাত্র ৩০ শতক আবাদি জমি। উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুতে পরিবার দুটি এখন মহাবিপদে পড়ল।

বদরগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আসাদুজ্জামান মঙ্গলবার দুপুরে বলেন, পাটবোঝাই ট্রাকটি আটক করে থানায় রাখা হয়েছে। চালক ও সহকারী পালিয়ে গেছেন। এখন পর্যন্ত লিখিত অভিযোগ না পাওয়ায় থানায় কোনো মামলা করা হয়নি।