ছুটে চলছেন হেদায়েতুল

হেদায়েতুল মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে চান। প্রতিবন্ধীরাও চাইলে কিছু করতে পারে তা দেখিয়ে দিতে চান।

২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসে সফল প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ক্যাটাগরিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন হেদায়েতুল আজিজ
ছবি: সংগৃহীত

৩৯ বছর বয়সী যুবক হেদায়েতুল আজিজ। শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় হুইল চেয়ারই এখন তাঁর চলাফেরার প্রধান বাহন। কিন্তু শারীরিক এই অক্ষমতা কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে তাঁকে ঘরের চার দেয়ালে আটকে রাখতে পারেনি। প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে গঠন করেছেন একটি ক্রিকেট দল। গড়েছেন একটি সংগঠন। প্রতিবন্ধীদের চাকরির ব্যবস্থাও করেছেন। এসব কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কারও।

হেদায়েতুল জেলায় মুন্না নামে বেশি পরিচিত। তিনি জেলা শহরের পশ্চিম পাইকপাড়ার আইনজীবী আজিজুর রহমান ও আঞ্জুমান আরার ছেলে। তবে তিনি জন্ম থেকে প্রতিবন্ধী ছিলেন না। একটি অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনায় পায়ের শক্তি হারিয়ে ফেলেন।

পরিবারের লোকজন বলেন, ২০০৩ সালে একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি নিয়ে সৌদি আরবে পাড়ি জমান হেদায়েতুল। সেখানে ব্যবসাও ছিল তাঁর। ২০০৮ সালে একটি সড়ক দুর্ঘটনা তাঁর জীবন ওলট-পালট করে দেয়। আগস্টের প্রথম দিকে নিজে গাড়ি চালিয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে ফিরছিলেন। পথে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন হেদায়েতুল। দুমড়েমুচড়ে যায় তাঁর গাড়িটি। পরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাঁকে সেখানকার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দীর্ঘ ২২ দিন কোমায় ছিলেন তিনি।

দুর্ঘটনায় প্রাণে রক্ষা পেলেও কোমর থেকে শরীরের নিচের অংশ অবশ হয়ে যায়। পরে হুইল চেয়ারে বাড়ি ফেরেন তিনি। এরপর নতুন উদ্যমে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু করেন। ফিজিওথেরাপিস্ট লাকি আক্তারের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

হেদায়েতুল বলেন, ‘লক্ষ্য, দৃঢ় প্রত্যয় ও সাহস থাকলে প্রতিবন্ধিতাকে জয় করা সম্ভব। দৃষ্টিভঙ্গির ওপর সবকিছু নির্ভর করে। হুইল চেয়ারে বসে জীবনের শেষ টানতে চাইনি। কিছু করার অদম্য চেষ্টা আমাকে সামনে যেতে সহযোগিতা করেছে। আমার চাওয়া একটাই, প্রতিবন্ধীদের মূল স্রোতোধারার মানুষের সঙ্গে একত্র করা। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে চাই—প্রতিবন্ধীরাও চাইলে কিছু করতে পারে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৩ সালে হেদায়েতুল প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ড্রিম ফর ডিজ-অ্যাবিলিটি ফাউন্ডেশন। এই সংগঠনের অধীনে দেশের ২০ জেলা থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে ড্রিম ফর ডিজ-অ্যাবিলিটি ফাউন্ডেশন (ডিডিএফ) হুইল চেয়ার ক্রিকেট দল, বাংলাদেশ গঠন করেন। দলের ৬০ জন সদস্যের মধ্যে ৫০ জনই শারীরিক প্রতিবন্ধী খেলোয়াড়।

হেদায়েতুলের নেতৃত্বে ডিডিএফ হুইল চেয়ার ক্রিকেট দল, বাংলাদেশ ২০১৭ সালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় টি-২০ সিরিজে এবং ২০১৯ সালে ভারতের কলকাতায় নেপাল-ইন্ডিয়া-বাংলাদেশের হুইল চেয়ার ক্রিকেট দলের টি-২০ ট্রাই নেশন সিরিজে অংশ নেয়। এসব সিরিজ জয় করে তাঁর ক্রিকেট দল। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি ডিডিএফ শারীরিক প্রতিবন্ধী ফুটবল দল শুরু করেন।

তিনি প্রতিবন্ধীদের আত্মনির্ভরশীল করার দায়িত্বও পালন করছেন। ডিডিএফ ও তাঁর প্রচেষ্টায় জেলার পুলিশ লাইনস স্কুলে শারীরিক প্রতিবন্ধী সাদ্দাম হোসেন শিক্ষকতার চাকরি পান। জেলার বিডি অ্যানিমেল হেলথ নামের প্রতিষ্ঠানে আটজন, ঢাকায় তিনজনের চাকরির ব্যবস্থা করেছেন।

আইডিয়াল রেসিডেনসিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজর অধ্যক্ষ সোপানুল ইসলাম বলেন, চাইলে প্রতিবন্ধিতাকে জয় করা যায়, এর উদাহরণ হেদায়েতুল। ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস উপলক্ষে ৫ ডিসেম্বরের অনুষ্ঠানে সফল প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ক্যাটাগরিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন তিনি। করোনাকালে তিনি ৩ হাজার ৬৯২ জন প্রতিবন্ধী ও তাঁদের পরিবারের মধ্যে খাদ্য ও ত্রাণ বিতরণ করেন।