ছেলেদের রক্ষায় প্রাণ দেন দুই বাবা

হাওরে ট্রলারডুবিতে নিহতের ঘটনায় স্বজনদের কান্না।
ফাইল

নেত্রকোনার মদন উপজেলার রাজালিকান্দা হাওরে ৫ আগস্ট প্রবল বাতাস ও ঢেউয়ের কারণেই ট্রলারডুবি ঘটেছিল। সেখানে দুই সন্তানকে বাঁচাতে গিয়ে মাহফুজুর রহমান, এক সন্তানকে বাঁচাতে গিয়ে শফিকুর রহমানসহ ১৮ জন মারা যান। ওই ঘটনায় গঠিত তদন্ত প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।

আজ বুধবার সন্ধ্যায় ওই প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকের কাছে জমা দেওয়ার কথা। তার আগে বিকেলে কমিটির প্রধান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. বুলবুল আহমেদ প্রথম আলোকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

উপজেলা প্রশাসন ও তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ৫ আগস্ট ময়মনসিংহ সদর উপজেলার কোনাপাড়া এলাকায় মারকাসুন্না হাফিজিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ৪৮ জনের একটি দল মদনের উচিতপুর ট্রলারঘাটে আসে। সেখান থেকে দুপুর ১২টার দিকে তারা একটি ট্রলার ভাড়া করে হাওর ভ্রমণে বের হয়। ১৫ মিনিট পর ট্রলারটি রাজালিকান্দা হাওরে ডুবে যায়। এতে ১৮ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে পাঁচজন শিশু রয়েছে। তাদের বয়স ৭ থেকে ১২ বছর। এ দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে পরদিন জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। চার সদস্যবিশিষ্ট এ কমিটির প্রধান করা হয় ইউএনও বুলবুল আহমেদকে। আজ সন্ধ্যায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা।

প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নৌকার ধারণক্ষমতা নির্ণয় করে যাত্রী পরিবহন ও সুরক্ষাসামগ্রী রাখা, নৌ পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন ও মদনে সার্বক্ষণিক ডুবুরি দল রাখা।

জানতে চাইলে ইউএনও বুলবুল আহমেদ জানান, প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে, আকস্মিকভাবে হাওরে প্রবল বাতাস বয়ে যায়। এ সময় প্রচণ্ড ঢেউয়ের কবলে পড়ে ট্রলারটি উল্টে যায়। ঘটনাস্থলে পানির গভীরতা ছিল ১০ থেকে ১২ ফুট। যাত্রীদের মধ্যে যাঁরা প্রাপ্তবয়স্ক ও সাঁতার জানতেন, তাঁরা আতঙ্কিত না হয়ে সাঁতার কাটলে হয়তো বেঁচে যেতেন। ট্রলারের যাত্রীদের প্রায় অর্ধেক ছাদে ছিলেন। তাঁরা পানিতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে তীরে ওঠার চেষ্টা করেন। অনেকেই অর্ধডুবন্ত ট্রলারে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেন। ভেতরের যাত্রীরা দ্রুত বের হয়ে একে অপরকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করেন।

ইউএনও আরও জানান, মাদ্রাসাশিক্ষক মাহফুজুর রহমান (৪৫) ও শফিকুর রহমান (৪০) সাঁতার কেটে ট্রলারের কাছে আসেন। একপর্যায়ে মাহফুজের দুই ছেলে মাহবুবুর রহমান (১৫) ও মাহমুদ মিয়া (১২) এবং শফিকুলের ছেলে সামান মিয়া (১০) ‘আব্বা, বাঁচাও’ বলে চিৎকার দিয়ে ডুবে যেতে থাকে। এ দৃশ্য দেখে মাহফুজ ও শফিকুর তাদের বাঁচাতে আবার পানিতে ঝাঁপ দেন। কিন্তু বাবা-সন্তানসহ পাঁচজনই মারা যান। দুর্ঘটনায় নিহত ১৮ জনের মধ্যে ১৫ জনের লাশ উদ্ধারকর্মীরা একসঙ্গে উদ্ধার করেন। তাঁরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ছিলেন। আর দুজনের লাশ পৃথক স্থান থেকে উদ্ধার করা হয়। ঘটনার পরদিন মো. রাকিব (২৫) নামের আরও একজনের লাশ ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।

তদন্ত কমিটির প্রধান বলেন, প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নৌকার ধারণক্ষমতা নির্ণয় করে যাত্রী পরিবহন ও সুরক্ষাসামগ্রী রাখা, নৌ পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন ও মদনে সার্বক্ষণিক ডুবুরি দল রাখা। অবশ্য ওই ঘটনার পর উচিতপুর ট্রলারঘাট থেকে লাইফ জ্যাকেট, বয়াসহ পর্যাপ্ত সুরক্ষাব্যবস্থা ছাড়া কোনো নৌযান চলাচল করছে না। আর বড় নৌযানে সর্বোচ্চ ২০ জনের বেশি যাত্রী পরিবহন করা হয় না। এ বিষয়ে সার্বক্ষণিক প্রশাসনের নজরদারি রয়েছে।

স্থানীয় লোকজন জানান, তিন বছর আগে মদন থেকে খালিয়াজুরি পর্যন্ত নির্মিত ডুবো সড়কের উচিতপুর ট্রলারঘাট–সংলগ্ন বালই এলাকায় দৃষ্টিনন্দন পাকা সেতু নির্মাণ করা হয়। এরপর এ এলাকা ভ্রমণপিপাসুদের কাছে আকর্ষণীয় জায়গায় পরিণত হয়। প্রতিবছর বর্ষায় পানি আসার পর সেখানে ভিড় উপচে পড়ে। প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার পর্যটকের সমাগম ঘটে। এ এলাকায় ছোট-বড় পাঁচ শতাধিক নৌযান চলাচল করে। কোনো ফিটনেস পরীক্ষা ছাড়াই নৌকাগুলোয় শ্যালো ইঞ্জিন বসিয়ে চলাচল করা হয়। এ বছর উচিতপুর এলাকার খায়রুল ইসলাম উপজেলা প্রশাসনের কাছ থেকে ১৭ লাখ ৯৫ হাজার টাকায় ইজারা নিয়ে ট্রলারঘাট পরিচালনা করছেন। কিন্তু নৌযানগুলো থেকে দৈনিক ইজারা আদায় ব্যতীত কোনো নজরদারি ছিল না। প্রশাসনেরও নজরদারির অভাব ছিল।

জানতে চাইলে ইজারাদার খায়রুল ইসলাম জানান, দুর্ঘটনার পর ইজারাদার ও নৌকার মালিকদের পক্ষ থেকে ১০০টি লাইফ জ্যাকেট এবং ১৫০টি টিউব ও টায়ার বিতরণ করা হয়েছে। আরও বেশ কিছু সুরক্ষাসামগ্রী বিতরণ করা হবে।

পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আকবর আলী মুন্সী বলেন, ‘ওই ঘটনায় এখন পর্যন্ত মামলা হয়নি। নিহতের স্বজনেরা মামলা করতে আগ্রহী নন। আমরা নৌকাটির মালিক লাহুত মিয়া ও চালক শাহবাজ মিয়াকে নজরদারিতে রেখেছি। অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেব। ওই ঘটনায় প্রশাসনের পাশাপাশি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকেও তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।’