ছোট দেশের বড় বিজ্ঞানী

যে গুটিকয়েক বিজ্ঞানী মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের বিপরীতে স্টেডি স্টেট থিউরি মেনে চলেন, তাদের অন্যতম জয়ন্ত নারলিকর কেমব্রিজে জামাল নজরুলের সহপাঠী ছিলেন। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের আঙিনায় তখন একঝাঁক তরুণ-তরুণীর বিচরণ। যাঁদের অনেকেই পরে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

জামাল নজরুল ইসলাম

‘বাংলাদেশের একটি ছেলে বা মেয়েকে যদি আমি বিজ্ঞানের পথে নিয়ে আসতে পারি, যদি তার সামনে মহাবিশ্বের রহস্য অনুসন্ধানের একটি নতুন দরজা খুলে দিতে পারি, তাহলেই আমার দেশে ফেরা সার্থক হবে।’ ৩০ বছরের বিলাতি জীবনের অভ্যস্ততা, কেমব্রিজে অগ্রসর বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ, চমৎকার গবেষণার পরিবেশ, সর্বোপরি মাস শেষে বাংলাদেশের টাকায় লাখ টাকা বেতন—সবকিছু ছেড়ে নিজ দেশে ফিরে আসা প্রসঙ্গে আমাদের বিজ্ঞানী, বিশিষ্ট তাত্ত্বিক কসমোলজির অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম প্রায়ই ওপরের কথাগুলো বলতেন। কথাগুলো যে কেবল তাঁর সহধর্মিণী বা পরিবারের বন্ধুদের বলতেন তা নয়, জানাতেন বিলাতে তাঁর সতীর্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংকেও। কারণ, হকিং চাইতেন জামাল নজরুল ইসলাম বিলাতেই থেকে যান। হকিং প্রায়ই বলতেন, তুমি এখানে থেকেই তো দেশের জন্য অনেক কাজ করতে পারো।

বিলাতে থেকেও দেশের জন্য কাজ করা যায় জামাল নজরুল ইসলাম সেটি জানতেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার যেন বাংলাদেশের পক্ষে থাকে, সে জন্য তিনি প্রায় সব ব্রিটিশ এমপির কাছে চিঠি লিখেছেন। এমনকি ব্রিটিশ এমপি লর্ড বাটলারের মাধ্যমে গণচীনের সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের কাছে অনুরোধ করেন, যেন চীন পাকিস্তানের পক্ষে না দাঁড়ায়। তবে হকিংয়ের কথামতো এ রকম কিছু করাটা বাংলাদেশের মতো নতুন একটি দেশের জন্য যথেষ্ট নয়। বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে বাংলাদেশের তরুণদেরও বিজ্ঞানের উচ্চতর শাখাগুলোতে অবাধ সন্তরণ শিখতে হবে। কেমব্রিজে নিজের গবেষণা করে বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের একটি নতুন চ্যালেঞ্জিং জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। এ কারণে জামাল নজরুল ইসলাম দেশে ফেরেন। তিনি হয়ে উঠলেন আমাদের মতো ছোট দেশের এক বিশাল বড় বিজ্ঞানী।

মধ্য আশির দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর মূল বেতন নির্ধারণ করা হয় মাত্র তিন হাজার টাকা। সেই সময় অনেকেই তাঁর এই সিদ্ধান্তে অবাক হয়েছেন; কিন্তু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি জানতেন, তিনি ভুল করেননি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন গাণিতিক ও ভৌতবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র (স্টিফেন হকিং একই কাজ করেছেন কেমব্রিজে, তবে সেটি জামাল নজরুল ইসলামের দেড় দশক পরে)। নিজের কাজ দিয়ে তিনি জানতেন, তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান আর কসমোলজির আঙিনায় চরে বেড়ানোর মতো শিক্ষার্থী এ দেশেই আছেন। দরকার কেবল তাঁদের পথ দেখানো এবং রসদ জোগান দেওয়া। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথমেটিক্যাল ও ফিসিক্যাল সায়েন্সে তাঁর অধীনে মাত্র ৫০ জন শিক্ষার্থী এমফিল ডিগ্রি লাভ করেছেন। আর ৩৩ জন পেয়েছেন পিএইচডি ডিগ্রি। তাঁদের প্রত্যেকের কাজই আন্তর্জাতিক মানের। মনে রাখতে হবে, যে সময়ে জামাল নজরুল ইসলাম তাঁর এই শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক মানের গবেষণায় অনুপ্রাণিত করেছেন, তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তেমন ভালো মানের ইন্টারনেট সংযোগই ছিল না।

ছাত্রছাত্রীদের অনুপ্রাণিত করা, তাঁদের অভিভাবক হওয়ার পরেও তিনি তাঁর নিজের গবেষণা এবং কাজের সময়টুকু ঠিকই বের করে নিতেন। ১৯৯২ সালে তাঁর অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথেমেটিক্যাল কসমোলজি বইটি প্রকাশিত হয়। এরও পরে লিখেছেন ফার ফিউচার অব দ্য ইউনিভার্স। তবে জামাল নজরুলের সবচেয়ে বিখ্যাত বইটি হলো দি আলটিমেট ফেট অব দ্য ইউনিভার্স। ১৯৮৩ সালে কেমব্রিজ প্রেস থেকে প্রকাশের পর এটি ফরাসি, পর্তুগিজ, যুগোস্লাভ ও জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বইটি তাঁর নিজের গবেষণার সারাংশ। গবেষণার সন্দর্ভ হাতে পাওয়ার পর বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রিম্যান ডাইসন তাঁর মতো দুনিয়ার শেষ পরিণতি সম্পর্কে আকৃষ্ট হোন। অধ্যাপক জামালের মৃত্যুর পর তিনি স্মরণ করেছেন, ‘জামাল ইসলামের কাজ আমাকে দুনিয়ার শেষ পরিণতি সম্পর্কে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেছে। জামাল ইসলাম সেই কাজটিই করেছেন, যা কি না অনেকেই করতে চান না, কারণ কাজটা কঠিন।’

দুনিয়ার শেষ পরিণতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য অনেক ঘটনা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া লাগে। প্রোটন কণার লয় থেকে দুনিয়ার তাপীয় মৃত্যু। এখনো বিজ্ঞানীরা মহাবিস্ফোরণ থেকে এই দুনিয়ার সৃষ্টি হয়েছে বলে বিশ্বাস করলেও দুনিয়ার শেষ পরিণতি কী হবে তা নিয়ে নিশ্চিত হতে পারেননি। প্রসারণ দিয়ে যার শুরু, সংকোচন দিয়ে তার শেষ কি না কে জানেন? তবে জামাল নজরুল ইসলাম দেখিয়েছেন শেষের দিকে এক মহাশূন্যতা সৃষ্টি হতে পারে। যে গুটিকয়েক বিজ্ঞানী মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের বিপরীতে স্টেডি স্টেট থিউরি মেনে চলেন, তাদের অন্যতম জয়ন্ত নারলিকর কেমব্রিজে জামাল নজরুলের সহপাঠী ছিলেন। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের আঙিনায় তখন একঝাঁক তরুণ-তরুণীর বিচরণ। যাঁদের অনেকেই পরে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

বিকেল হলে জামাল-সুরাইয়া জুটি তাঁদের দুই মেয়ে সাদাফ আর নার্গিসকে নিয়ে হাঁটতে চলে যেতেন নদীর পাড়ে। কোনো কোনো দিন সঙ্গী হন স্টিফেন আর জেন হকিং, সঙ্গে তাঁদের ছেলে রবার্ট আর মেয়ে লুসি। আলোচনায় সৃষ্টিতত্ত্ব যেমন আসে, তেমনি আসে প্রকৃতির কথাও। প্রকৃতির সত্য উদ্‌ঘাটন করতে হলে প্রকৃতিকে নিজের মতো করে জানা দরকার। এই বোধ থেকে অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম তাঁর মেয়েদের প্রকৃতি পাঠে উৎসাহ দিতেন।

দেশে ফিরবেন এই পরিকল্পনা তাঁর শুরু থেকেই ছিল। তাই ঠিক সময়ে মেয়েদের বাংলা শেখানো শুরু করেন, সঙ্গে গান–বাজনা। আইনস্টাইনের জগতের এই ব্যক্তি চমৎকার করে পিয়ানো ও সেতার বাজাতে পারতেন। চট্টগ্রামে তাঁর বাসায় নিয়মিত বসতো গানের আসর। কখনো কখনো জামাল স্যার বসে পড়তেন হারমোনিয়াম নিয়ে। স্ত্রী সুরাইয়া ইসলামও গলা মেলাতেন তাঁর সঙ্গে।

বিজ্ঞানের গবেষণা ছাড়াও অর্থনীতি আর সমাজ সংস্কারের বিষয়টিকেও শেষ জীবনে প্রাধান্য দিয়েছেন এই অধ্যাপক। তিনি বিশ্বাস করতেন, পশ্চিমাদের প্রেসক্রিপশনে আমাদের মুক্তি নেই। উন্নত বিশ্বের প্রতি তাঁর একটিই অনুরোধ ছিল—‘তোমরা শুধু আমাদের পথ থেকে সরে দাঁড়াও, আমাদের ভালোমন্দ আমাদেরই ভাবতে দাও।’

জামাল নজরুল বিশ্বাস করতেন, নতুন প্রজন্ম ঠিকই পথ বের করে ফেলবে। সে কারণে নতুনদের প্রায় সবটাতেই তার সমর্থন থাকত। আমরা যখন গণিত অলিম্পিয়াড শুরু করি, এমনকি যখন আমাদের কমিটিও হয়নি, তখন থেকে তিনি আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন। আমৃত্যু ছিলেন আমাদের গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সদস্য।

প্রতিদিন নাশতার টেবিলে কোনো না কোনো অঙ্কের সমাধান করতেন। কোনো কোনো সময় ব্যবহার করতেন দৈনিক পত্রিকার মার্জিনের খালি অংশ। একটি সমস্যা সমাধানে পটু প্রজন্মের সন্ধান করে গেছেন আমৃত্যু।

দেশের শিক্ষার্থীদের যদি বেশি করে আমরা গণিত আর বিজ্ঞানের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করতে পারি, তাহলেই কেবল এই বড় মাপের বিশ্ববিজ্ঞানীর প্রতি আমাদের প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো সম্পন্ন হবে।

মুনির হাসান: প্রথম আলোর যুব কর্মসূচি ও অনুষ্ঠান প্রধান