জনারণ্যে মাদকবিরোধী প্রচারণা করাই তাঁদের সাজা

বিভিন্ন মামলায় প্রবেশনে থাকা আসামিরা চালাচ্ছেন মাদকবিরোধী প্রচারণা। কারাভোড়ের পরিবর্তে আদালতের আদেশে এটাই তাঁদের সাজা। আজ সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সিলেট জেলা দায়রা জজ আদালত প্রাঙ্গণেপ্রথম আলো

এক সারিতে দাঁড়ানো সবাই। একজনের হাতে হ্যান্ডমাইক। তিনি উচ্চ স্বরে মাদকের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর স্লোগান শুনে সারিবদ্ধ দাঁড়ানো সবাই একসঙ্গে সমস্বরে সেসব স্লোগানই আওড়াচ্ছেন। এভাবে একনাগাড়ে প্রায় আধঘণ্টা সমস্বরে স্লোগানের মাধ্যমে মাদকবিরোধী প্রচারণা চালান তাঁরা। প্রতি মাসে একবার এভাবে জনারণ্যে মাদকবিরোধী প্রচারণা চালানো তাঁদের আদালত নির্দেশিত সাজা।

সিলেট সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রবেশন থেকে পরিচালিত ৮৬ ব্যক্তি এভাবেই কৃত অপরাধেরা সাজা ভোগ করছেন। আজ সোমবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত সিলেটের আদালত এলাকার মধ্য দিয়ে তাঁরা জনারণ্যে মাদকবিরোধী প্রচারণা পর্ব চালিয়েছেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, সাজাপ্রাপ্ত এই ৮৬ জনের মধ্যে ১০ জন নারীও আছেন। তাঁদের একজন জানান, ভুল করে মাদক বহন করায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলায় এক বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। কথা বলার একপর্যায়ে ওই নারী কান্না সংবরণ করে বলেন, ‘বাড়িতে আমার তিনটা অবুঝ বাইচ্চা। ভুল পথে ভুল কইরা জড়াইছিলাম। যদি জেল খাটতাম, তাইলে তো আমার সংসার শেষ অই যাইত।’

ভুল করে মাদক বহন করায় আমার এক বছরের কারাদণ্ড হইছিল। বাড়িত আমার তিনটা অবুঝ বাইচ্চা। ভুল পথে ভুল কইরা জড়াইছিলাম। যদি জেল খাটতাম, তাইলে তো আমার সংসার শেষ অই যাইত।
প্রবেশনে থাকা এক নারী

ওই নারীর পাশে অনর্গল মাদকবিরোধী স্লোগান দিচ্ছিলেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ গ্রামের এক ব্যক্তি। ‘মাদককে না বলুন, মাদককে ঘৃণা করুন, মাদক থেকে বিরত থাকুন, মাদক কেনাবেচা দণ্ডনীয় অপরাধ, মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করব...’ একনাগাড়ে এসব স্লোগান বলে শেষে ‘আমরা এমন জগৎ গড়ব, মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করব’ স্লোগান দিয়ে থামলেন তিনি। জানতে চাইলে ওই ব্যক্তি বলেন, বাড়ির সামনে ছয়টি গাঁজার গাছ লাগিয়ে মামলার আসামি হয়েছিলেন। মামলার রায়ে তাঁর এক বছরের সাজা হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘গাছটা না বুইঝা লাগাইছিলাম। ধরা পড়ার পর বুঝছি, এইটা অপরাধ। এক বছরের জেল হইলে দিশেহারা আছিলাম। মুক্তি পাইছি এখন। এক-দুদিন না, যত দিন বাঁচব, মদ-গাইঞ্জার (গাঁজা) বিরুদ্ধে থাকমু।’

গোলাপগঞ্জের এক নারীর সঙ্গে দুই শিশুপুত্রও আছেন। মাদক আইনে তাঁর বিরুদ্ধে মামলায় দুই বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। প্রবেশনে মুক্ত হয়েছেন। আদালত তাঁকে যে শর্ত দিয়েছেন, সেই শর্ত অক্ষরে অক্ষরে পালন করছেন এবং প্রতি মাসেই প্রবেশনে হাজির হচ্ছেন জানিয়ে ওই নারী বলেন, ‘যদি এই সুযোগ না পাইতাম, দুই বাচ্চার দশা কিতা অইত, ভাবতে পারি না। আমি এই বিচারে সারা জীবন কৃতজ্ঞ।’

বিভিন্ন মামলায় প্রবেশনে থাকা আসামিদের নিয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের আয়োজনে মাদকবিরোধী কর্মসূচি। আজ সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সিলেট জেলা দায়রা জজ আদালত প্রাঙ্গণে
প্রথম আলো

সিলেটের আদালত এলাকায় ৮৬ জনের একসঙ্গে মাদকবিরোধী প্রচারণা প্রত্যক্ষ করেছেন সিলেট জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) নিজাম উদ্দিন, মহানগরের পিপি নওশাদ আহমদ চৌধুরী, সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এ কে এম সমিউল আলম ও বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) সিলেটের সমন্বয়ক আইনজীবী ইরফানুজ্জামান চৌধুরী। তাঁরা সাজা ভোগকারীদের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন।

৫২টি মামলার প্রবেশন মেয়াদ শেষ হয়েছে, ৯৯টি চলমান। এই ৯৯ মামলার মধ্যে মাদক আইনের মামলায় ৮৬ জন মাদকবিরোধী প্রচারণা চালানোর আদেশ পেয়েছেন।

সিলেট সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রবেশন শাখা জানায়, ২০১৪ সালে প্রধান বিচারপতির নির্দেশে দেশে সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রবেশন কার্যক্রম শুরু হয়। সিলেট জেলায় মাদক আইন, পারিবারিক জটিলতাসহ ছোটখাটো ঘটনায় ১৫১টি মামলা প্রবেশনের অধীন আছে। ৫২টি মামলার প্রবেশন মেয়াদ শেষ হয়েছে, ৯৯টি চলমান। এই ৯৯ মামলার মধ্যে মাদক আইনের মামলায় ৮৬ জন মাদকবিরোধী প্রচারণা চালানোর আদেশ পেয়েছেন।

এ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন সিলেটের প্রবেশন কর্মকর্তা তমির হোসেন চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রতি মাসে নির্দিষ্ট একটি দিনে তাঁরা প্রবেশনে এসে হাজিরা দিচ্ছেন। এটি আদালতেরই নির্দেশনা ছিল। আদালত এলাকায় প্রচারণা ছাড়াও আগামী মাসে আরেকটি জনারণ্যে প্রচারণা চালানোর স্থান নির্ধারণ করা হবে। এই ৮৬ জনের মধ্যে ১০ নারীও আছেন। তাঁদের অবিরাম প্রচারণা চালাতে গিয়ে মাদকের বিরুদ্ধে মনেপ্রাণে এককাট্টা থাকতে দেখা গেছে। জেল না খেটে বাইরে থেকে সামাজিক দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে সাজ ভোগ করায় ইতিবাচক পরিবর্তন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা।