জল-পাথরে বাহন এবার ঘোড়া

সাদা পাথর এলাকায় পর্যটকদের জন্য নতুন বাহন ঘোড়া নিয়ে অপেক্ষা করছেন কালা মিয়া। করোনাকালে পেশা বদল করে তিনি দুটো ঘোড়া কিনেছেন। গত বৃহস্পতিবার বিকেলেপ্রথম আলো

অবারিত জলরাশির মধ্যে স্তূপ স্তূপ পাথর। একপাশে পাহাড়ের পাদদেশ। এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী পর্যটনকেন্দ্র ‘সাদা পাথর’–এ এত দিন যাতায়াতে নৌকাই ছিল একমাত্র বাহন। এবার নৌকার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঘোড়া। এখন থেকে ইচ্ছা হলে ঘোড়সওয়ার হয়ে সাদা পাথরে পা রাখা যাবে। আর এই সুযোগে আরেক জীবিকার পথ পেয়েছেন ওই এলাকার বাসিন্দারা।

গতকাল বৃহস্পতিবার সাদা পাথর এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে নতুন এই চিত্র। সাদা পাথর যাওয়ার নৌঘাটটি কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ ১০ নম্বর এলাকায়। ধলাই নদের উৎসমুখ হয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকা করে ১৫ থেকে ২০ মিনিটের পথ। এরপর নৌকা থেকে নেমে আরও কিছুটা হাঁটাপথ। সেই পথের বাহন হয়েছে ঘোড়া।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, সাদা পাথর এলাকায় ঘোড়সওয়ার হওয়ার এই রোমাঞ্চকর যাত্রা এবারই প্রথম শুরু হয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় দফায় লকডাউনে সিলেটের অন্যান্য পর্যটনকেন্দ্রের মতো সাদা পাথরও ছিল পর্যটকশূন্য। গত মঙ্গলবার সকাল থেকে সীমান্তের ওপারে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে থেমে থেমে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। ওপারে বৃষ্টি হওয়ায় পাহাড়ি ঢলের পানি নামতে শুরু করেছে সাদা পাথরে। নতুন পানির সঙ্গে নতুন বাহন ঘোড়া। তাই পর্যটকদের ভিড়ও ক্রমে বাড়ছে। অবশ্য উপজেলা প্রশাসন করোনা বিষয়েও সতর্ক থাকতে বলছে।

বৃহস্পতিবার বিকেলে সাদা পাথর এলাকায় দেখা যায়, ধলাই নদের উৎসমুখে স্রোতোধারা কয়েক গুণ বেড়েছে। জলমগ্ন হয়ে পড়েছে পাথরের আচ্ছাদনে থাকা অধিকাংশ এলাকা। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বন্যার আশঙ্কায় নদ-নদীর পানিপ্রবাহ পরিমাপের প্রস্তুতি নিয়েছে।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, সাদা পাথর এলাকায় ঘোড়সওয়ার হওয়ার এই রোমাঞ্চকর যাত্রা এবারই প্রথম শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ধলাই নদের উৎসমুখে সাদা পাথর এলাকার অবস্থান। ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ি অঞ্চল লুংলংপুঞ্জি ও শিলংয়ের চেরাপুঞ্জি। এপারে ধলাই নদের উৎসমুখের বিস্তৃত এলাকায় সারা বছর নদের পানিপ্রবাহ থাকে। বৃষ্টিবহুল চেরাপুঞ্জির পাদদেশ থেকে বর্ষায় ঢলের পানির সঙ্গে পাহাড়ের পাথরখণ্ড এপারে নেমে আসে। ২০১৭ সালে পাহাড়ি ঢলে পাথর জমা হওয়ায় কোম্পানীগঞ্জের তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবুল লাইছ পাথরগুলো সংরক্ষণ করেন। এ নিয়ে ২০১৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় ‘ধলাইমুখে আবার জমল “ধলাসোনা”’ শিরোনামে একটি সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়। সেই থেকে এলাকাটি ‘সাদা পাথর’ পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পায়।

সীমান্তের ওপারে ভারতের চেরাপুঞ্জি। সেখানে ভারী বৃষ্টি হলে পাহাড়ি ঢল নামে সিলেটের নতুন পর্যটনকেন্দ্র কোম্পানীগঞ্জের সাদা পাথর এলাকায়। এ মৌসুমে প্রথম পাহড়ি ঢল নামে গত মঙ্গলবার বিকেলে। ওই দিনের ছবি
প্রথম আলো

সীমান্তের ওপারে পাহাড়, পাথর আর স্বচ্ছ জলের অবগাহনে বছরজুড়ে সাদা পাথর এলাকায় পর্যটকদের যাতায়াত থাকে। পাহাড়-জল ও পাথরের সৌন্দর্যের ওই এলাকায় বেড়াতে গিয়ে অনেকে গোসল করেন। পর্যটকদের যাতায়াত বেশি হয় গ্রীষ্মকালে। আর এই সময়েই পাহাড়ি ঢলও নামে। সিলেটে সাধারণত পাহাড়ি ঢল থেকে বন্যা দেখা দেয়। কোম্পানীগঞ্জের ধলাই ও গোয়াইনঘাটের জাফলংয়ের পিয়াইন নদ হয়ে পাহাড়ি ঢল নামে।

পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ শহীদুজ্জামান সরকার প্রথম আলোকে বলেন, এ মাসে সিলেট অঞ্চলে বন্যার পূর্বাভাস আছে। এ জন্য পাউবো সিলেট অঞ্চলে যেসব নদ-নদীর পানিপ্রবাহ পরিমাপ করে, সেখানে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ শুরুর প্রস্তুতি নিয়েছে। দুই দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। ওপারেও ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে নদ-নদীর পানিপ্রবাহ প্রতিদিন পরিমাপ শুরু করা হবে।

গত মঙ্গলবার দিনভর ওপারে ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ায় বিকেল থেকে ঢল নামা শুরু হয় সাদা পাথর এলাকায়। এরপর থেকে যখনই পাহাড়ে ভারী বৃষ্টি হয়, সাদা পাথরেও ঢল নামে। নতুন ঢল দেখতে পর্যটকেরা ভিড় করছেন। সাধারণত ছুটির দিন সেখানে বেড়াতে যাওয়া মানুষের ভিড় বেশি হয়।

বৃহস্পতিবার বিকেলে সরেজমিন দেখা যায়, ঘাট থেকে নৌকায় করে গিয়ে বাকি হাঁটা পথটুকুতে ব্যবহার হচ্ছে ঘোড়া। সাধারণত ছুটির দিন সাদা পাথর এলাকায় বেড়াতে যাওয়া মানুষের ভিড় হয় বেশি। তাই আজ শুক্রবার সামনে রেখে গতকাল বিকেলে নৌঘাটেই সাজিয়ে রাখা হয়েছে চারটি ঘোড়া। একেক ঘোড়ার একেক নাম। ঘোড়ায় চড়ে ছবি তুললে জনপ্রতি ২০ টাকা। আর ঘোড়সওয়ার হয়ে পথ চললে ৫০ টাকা নেন ঘোড়ার মালিকেরা।

কালা মিয়া আর তাঁর ঘোড়া ‘বাহাদুর’। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে সাদা পাথর এলাকায়
প্রথম আলো

একসঙ্গে দুটি ঘোড়া কিনে সাদা পাথর এলাকায় প্রথম ঘোড়া বাহনের প্রচলন করেন কোম্পানীগঞ্জের চানপুর গ্রামের কালা মিয়া (৪০)। ঘাটেই কথা হয় তাঁর সঙ্গে। কালা মিয়া বলেন, তিনি মাছবিক্রেতা ছিলেন। করোনার সময় মাছ কেনাবেচায় মন্দার কারণে পেশা বদল করেছেন। সাদা পাথর এলাকায় গ্রীষ্মকালে মানুষের সমাগম বেশি হয়। প্রায় ছয় মাস আগে সুনামগঞ্জের লাউড়েরগড় এলাকা থেকে দুটি ঘোড়া কেনেন। একটি ভাড়া দেন, আরেকটি নিজের কাছে রেখে পর্যটকদের ঘোড়সওয়ার করেন। এতে দৈনিক তাঁর ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা রোজগার হয়। দুই ঘোড়ার পেছনে খরচ হয় প্রতিদিন ২০০ টাকা।

কালা মিয়া যে ঘোড়াটি তাঁর সঙ্গে রাখেন, সেটির নাম রেখেছেন ‘বাহাদুর’। আর ভাড়া দেন ‘লালচান’ নামের ঘোড়াটি। ঘোড়া নিয়ে সাদা পাথর এলাকায় জীবিকার পথ তিনিই দেখিয়েছেন জানিয়ে কিছুটা গর্বের সঙ্গে বলেন, ‘মাছ কেনাবেচায় আর আগের মতো লাভ নাই। মাছ বেচা ছাড়ি দিছি। বুদ্ধি করি দুইটা ঘোড়া কিনছি পুঁজির টাকা দিয়া। আমার দেখাদেখি আরও ঘোড়া নামছে। মানুষের শখ মিটাই, রোজগার ভালোই।’

সাদা পাথর এলাকাটি পড়েছে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়নে। ইউপি চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন বলেন, সাদা পাথর এলাকা পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পাওয়ায় এই এলাকার অধিকাংশ মানুষের পেশার বদল হয়েছে। নৌঘাট থেকে আগে যেখানে কালেভদ্রে এক-দুটি নৌকা চলত, পর্যটক মৌসুমে এখন সেখানে ২০০ থেকে ৩০০ নৌকা চলে। তাতে অন্তত পাঁচ শতাধিক মানুষের জীবিকার সংস্থান হয়। এ ছাড়া সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ সড়কে ‘সাদা পাথর পরিবহন’ নামে যাত্রীবাহী বাসও চলাচল করছে। এবার সর্বশেষ সংযোজন ঘোড়া।

সিলেটের অন্য কোনো পর্যটন এলাকায় ঘোড়সওয়ার হওয়ার সুযোগ নেই। সাদা পাথর এলাকায় ঘোড়ায় চড়ার মধ্য দিয়ে পর্যটন এলাকায় এটিই প্রথম প্রচলন বলে জানিয়েছেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুমন আচার্য। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ছুটির দিন লোকসমাগম বেশি হয়। তাই সপ্তাহে অন্তত একবার ওই এলাকা পরিদর্শন করে সার্বিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করেন তিনি। যাতায়াতকারীদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচল ও পুরো এলাকা পরিচ্ছন্ন রাখার প্রচারণাও প্রশাসনিকভাবে চালানো হয়। ঘোড়া এই মৌসুম থেকে চলছে। ঘোড়ার চালকদেরও সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।