জলমহালের দ্বন্দ্বে তিন মাস ধরে ‘লকডাউন’

নগর ইউনিয়নে আটাই ও ক্ষিদ্রি আটাই গ্রামের মধ্যে বিরোধ। এর জেরে মাইকে ঘোষণা দিয়ে ক্ষিদ্রি আটাইকে ‘লকডাউন’ করেছে আটাই গ্রাম।

পুরো গ্রাম বিচ্ছিন্ন হওয়ায় সেচ দেওয়া যায়নি। পানির অভাবে ফাটল দেখা দিয়েছে ফসলি জমিতে। গত শনিবার বড়াইগ্রামের ক্ষিদ্রি আটাই গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

নাটোরের বড়াইগ্রামের নগর ইউনিয়নের ক্ষিদ্রি আটাই গ্রামের বাসিন্দাদের কাছে ‘লকডাউন’ মানে সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলা নয়, বরং নিজেদের গ্রাম থেকে আর কোথাও যেতে না পারা। ঘরের বাইরে বের হতে গেলেও আতঙ্কে থাকা। এই ‘লকডাউনে’ সামাজিক কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করতে গেলেও আসে নানা ধরনের বাধা। এসব বাধার মধ্যে ভীষণ কষ্টে দিন কাটছে তাঁদের।

প্রায় ৮০টি পরিবার বাস করা এই গ্রামে করোনা মোকাবিলায় ‘লকডাউন’ ঘোষণা করা হয়েছে—এমন নয়। এই গ্রামের বাসিন্দাদের অভিযোগ, পাশের আটাই গ্রামের বাসিন্দারা তাঁদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন। তিন মাস আগে আটাই গ্রামের মসজিদের মাইকে ঘোষণায় বলা হয়, ‘ক্ষিদ্রি আটাই গ্রাম লকডাউন’। এরপর থেকেই লকডাউনের মতো নিষেধাজ্ঞা নেমে আসে তাঁদের জীবনে।

আটাই ও ক্ষিদ্রি আটাই গ্রামের এক কোণে পাঙ্গিয়ার দিঘি। এটি ৫২ একরের একটি সরকারি জলমহাল (দুটি মৎস্য অভয়াশ্রমসহ)। ক্ষিদ্রি আটাই গ্রামের মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি প্রায় এক বছর আগে ৮ লাখ ১০ হাজার টাকায় তিন বছরের জন্য জলমহালটি সরকারের কাছ থেকে ইজারা নেয়। কচুরিপানা পরিষ্কার, মাছের পোনা ছাড়া, খাদ্য সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনা বাবদ এই সমিতি এ পর্যন্ত ৩৫ লাখ টাকা খরচ করে। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইজারা নিতে ব্যর্থ হয়ে আটাই গ্রামের বেশ কয়েকজন বাসিন্দা গত বছরের ডিসেম্বরে জোর করে দিঘিটির নিয়ন্ত্রণ নেন। সমবায় সমিতির জেলেদের সেখানে প্রবেশ করতেও বাধা দেন। এরপর থেকেই দুই গ্রামের মধ্যে বিরোধের শুরু। মাঝে কয়েকবার সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে।

ক্ষিদ্রি আটাই গ্রামের ৮০টি পরিবারে ২৬০ জনের বসবাস। অন্যদিকে আটাই গ্রামের চার শ পরিবারে ১ হাজার ২০০ লোকের বসবাস। ক্ষিদ্রি আটাই গ্রামের বাসিন্দাদের অভিযোগ, পাঙ্গিয়ার দিঘির নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ করতে আটাই গ্রামের বাসিন্দারা গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর মসজিদের মাইকে ও হ্যান্ডমাইকে ক্ষিদ্রি আটাই গ্রামকে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করে। পাশাপাশি বিলে গ্রামবাসীর যেসব জমি আছে, সেখানেও তাঁদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। বিলে নামলেই তাড়া করা হয়। এমনকি নিজ গ্রামেও তাঁরা ঘর থেকে বের হতে পারেন না। প্রতিপক্ষের লোকজন লাঠি–ফালা নিয়ে একাধিকবার গ্রামে ঢুকে হামলা চালান।

৩ এপ্রিল ক্ষিদ্রি আটাই গ্রামে গেলে কৃষক রহমত আলী অভিযোগ করেন, গত ২৪ ডিসেম্বর তাঁর বাড়িতে বোনের বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল। পরের দিন বিকেলে আটাই গ্রামের মসজিদের মাইকে ক্ষিদ্রি আটাই গ্রামকে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করে প্রতিপক্ষের লোকজন। আটাই গ্রামের কয়েক শ লোক লাঠি, ফালা নিয়ে ক্ষিদ্রি আটাই গ্রামে আসে। তাঁরা হ্যান্ডমাইকে ঘোষণা করেন, লকডাউন ভঙ্গ করলে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। এরপর বাড়ির ভেতরে ঢুকে ডেকোরেশনের জিনিসপত্র ও একটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে চলে যায়।

এ ঘটনায় রহমত আলী বাদী হয়ে বড়াইগ্রাম থানায় মামলা করেন। তাঁর অভিযোগ, এর দুই দিন পর প্রতিপক্ষের লোকজন মাঠে নেমে তাঁদের আটটি শ্যালো ইঞ্জিনচালিত সেচযন্ত্র ভাঙচুর করেন। মাঠে ও গ্রামের আশপাশে নজরদারি করতে শুরু করে। ১৪ মার্চ সন্ধ্যায় মাঠে যাওয়ার কারণে গ্রামের দুই যুবককে মারধর করা হয়। ২৪ মার্চ সকালে ইব্রাহিম হোসেন নামের একজন গরুর ঘাস কাটতে মাঠে গেলে প্রতিপক্ষরা তাঁকে অপহরণ করে ও গাছের সঙ্গে বেঁধে মারপিট করে। এসব ঘটনায় পুলিশের কাছে অভিযোগ করে লাভ হয়নি। তাই জীবন রক্ষায় গ্রামের বাসিন্দারা ঘরবন্দী হয়ে আছেন।

আপস করাতে ‘লকডাউন’

ক্ষিদ্রি আটাই মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুর রাজ্জাকের অভিযোগ, প্রতিপক্ষ পাঙ্গিয়ার দিঘি দখল করে নেওয়ায় ৩৫ লাখ টাকার ক্ষতিসাধনের পাশাপাশি অন্তত ১০ লাখ টাকার মাছ চুরি করে নিয়েছে। এ ছাড়া ২৫ বিঘা জমির সাড়ে ৭০০ মণ রসুন ও ১০ বিঘা জমির ২০০ মণ গম কেটে নিয়ে গেছে। প্রাণনাশের হুমকির মুখে তিনি নিজে, সাধারণ সম্পাদক সুলতান সরদার, কোষাধ্যক্ষ বেলাল সরদার গ্রাম ছেড়ে আত্মগোপনে আছেন। হামলার শিকার হওয়ার ভয়ে গ্রামের লোকজনও বাড়ি থেকে বের হতে পারেন না।

অভিযোগের বিষয়ে আটাই গ্রামের মাতবর খলিল সোনার বলেন, এত দিন ইজারা না নিয়ে তাঁরা দিঘিটি ভোগ করতেন। তাঁদের না জানিয়ে ক্ষিদ্রি আটাইয়ের কিছু লোক ইজারা নেন। কিন্তু আটাই গ্রামের বাসিন্দারা তা মানতে চাননি। তাই অন্যায় হলেও তাঁরা দিঘিটি দখল করেছেন। খলিল সোনার বলেন, যত দিন ক্ষিদ্রি আটাই গ্রামের লোকজন আপস না করবেন, তত দিন তাঁদের ‘লকডাউন’ করে রাখা হবে।

আটাই গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, যে সমবায় সমিতির নামের দিঘিটি ইজারা নেওয়া হয়েছে, তিনি সে সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তাঁকে অন্যায়ভাবে বের করে দিয়ে অন্য লোকদের নিয়ে সমিতির ‘ভুয়া কমিটি’ ইজারা নিয়েছে। এ নিয়ে অভিযোগ করা হলে ইউএনও ৪৫ দিন সময় দেন বিলের মাছ মেরে নেওয়ার জন্য। তাই তাঁরা মাছ মেরে নিয়েছেন।

জমিতে আবাদ করতে বাধা ও ‘লকডাউন’ প্রসঙ্গে আনোয়ার বলেন, ‘ওরা একসময় আমাদের খুব যন্ত্রণা দিয়েছে। তাই ওদেরকে আপসে বাধ্য করার জন্য এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। তবে এখন তা তুলে নেওয়া হয়েছে।’

বড়াইগ্রাম থানার ওসি আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ফৌজদারি অপরাধের অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরপর ঘরবন্দী থাকার বিষয়ে কেউ অভিযোগ দেয়নি।