জাকিরের সব ‘পাগলামি’ দেশের মানুষের জন্য

  • অন্তত ১০৯টি মসজিদ ও ৭৩ মন্দিরে জীবাণুনাশক স্প্রে করেছেন। ঈদের সময় ৩৫০ পরিবারকে দিয়েছেন চিনি, সেমাই, দুধ।

জাকির মণ্ডল
ছবি: সংগৃহীত

করোনা সংক্রমণের শুরুতেই একটি হ্যান্ডমাইক নিয়ে সচেতনতামূলক প্রচারে নেমেছিলেন জাকির মণ্ডল (৪১)। এলাকার লোকজন তখন তাঁকে ঠাট্টা করে ‘পাগলা’ বলতেন। মহামারির তুমুল অসময়ে এই পাগলাকেই পাশে পেয়েছিল এলাকার মানুষ।

মার্চ থেকে টানা সাত মাস তিনি সচেতনতামূলক এ কাজ করে বেড়িয়েছেন ফরিদপুর সদরের কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের পথঘাটে। কখনো হেঁটে হেঁটে, আবার কখনো মোটরসাইকেলে। এলাকায় শুধু মাইকিং করেই তিনি বসে থাকেননি। অন্তত ১০৯টি মসজিদ ও ৭৩টি মন্দির প্রাঙ্গণসহ বিভিন্ন বাড়িতে তিনি জীবাণুনাশক স্প্রে করেছেন। করোনার কারণে বিপন্ন হওয়া ৮০টি পরিবারে তিনি চাল দিয়েছেন। ঈদুল ফিতরের সময় ৩৫০টি পরিবারে পৌঁছে দিয়েছেন চিনি, সেমাই ও দুধ।

এখন আর জাকিরকে এলাকার কেউ ‘পাগল’ বলেন না। কৃষ্ণপুর গ্রামের বাসিন্দা জাকিরের প্রতিবেশী টেইলার ব্যবসায়ী আরিফ খান (৩৬) বলেন, ‘আসলে আমরা সবাই তো পাগল। কেউ পাগল সম্পত্তির জন্য, কেউ পাগল আত্মপ্রচারের জন্য, কেউ পাগল নিজের প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু জাকির পাগল দেশের জন্য, দশের জন্য, মানুষের জন্য।’

জাকির হোসেন মণ্ডল একজন ভুসিমাল ব্যবসায়ী। কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের মণ্ডলপাড়া গ্রামের মৃত সোবাহান মণ্ডলের ছেলে। তিনি বিবাহিত এবং দুই মেয়ে ও এক ছেলের বাবা।

করোনাকালে মানুষের পাশে দাঁড়াতে তিনি কারও কাছ কোনো আর্থিক সাহায্য নেননি। খরচ করেছেন নিজের ব্যক্তি উদ্যোগে। হ্যান্ডমাইক কেনা, মোটরসাইকেলের তেল, ৮০ পরিবারকে চাল কিনে দেওয়া বা ৩৫০টি পরিবারকে চিনি, সেমাই ও দুধ দেওয়ার সব কাজ তিনি করেছেন নিজের উদ্যোগে। শুধু এক পরিচিতজন তাঁকে একটি পিপিই জোগাড় করে দিয়েছিলেন।

সম্প্রতি কৃষ্ণনগর মণ্ডলপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, ব্যস্ততার শেষ নেই জাকিরের। বাড়ির সামনে একটি মুদিদোকানে বেচাকেনায় ব্যস্ত তিনি। দোকানটি দিয়েছেন গত ঈদুল আজহার দুই দিন আগে। দোকানের সামনেই মুজিব বর্ষ উপলক্ষে ভূমিহীন, গৃহহীন, দুস্থ ও অসহায় মানুষের জন্য নির্মিতব্য প্রকল্প আশ্রয়ণ-২–এর আওতায় ৩১টি ঘর নির্মাণের কাজ চলছে।

জাকির বলেন, এ কাজে কোনো দুই নম্বরি হতে দিচ্ছেন না তিনি। ঘরগুলোর বরাদ্দ যাতে প্রকৃত গৃহহীন ও ভূমিহীনেরা পান এবং জনপ্রতিনিধিরা যাতে টাকা খেয়ে কাউকে বরাদ্দ না দেয়, সেদিকেও খেয়াল রাখবেন তিনি। কোনো অনিয়ম হলে তিনি তাঁর প্রতিবাদ করবেন।

জাকির বলেন, এসব কাজে তাঁর প্রেরণা বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের বক্তব্য। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে। বঙ্গবন্ধু যদি একজন ব্যক্তি হয়ে সারা দেশকে একতাবদ্ধ করতে পারেন, তাহলে তিনি কেন দেশের একজন নাগরিক হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারবেন না। এ বোধ থেকেই তাঁর এ কাজে হাত দেওয়া।

জাকির আরও বলেন, ‘আগে এলাকার মানুষ আমাকে নিয়ে উপহাস করত, ভাবত পাগলের পাগলামি। কিন্তু মানুষ এখন বুঝতে পেরেছে আমার কাজ পাগলামি না। তাই তারা সচেতন হচ্ছে।’

জাকিরের স্ত্রী ফাহিমা বেগম বলেন, ‘লোকডা সারা দিন মাইক নিয়া পাগলের মতো ঘুইরা বেড়ায়। এলাকার লোকজন আগে তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করত। তখন খুব খারাপ লাগত। এখন সবাই তার কথার গুরুত্ব দেয় বলে ভালো লাগে।’