‘জান দিব, তবু জমি দিব না’

  • কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পপার্ক স্থাপনের জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ে ডিপিপি পাঠিয়েছে বিসিক।

  • ২ মার্চ পাঠানো এই প্রকল্প প্রস্তাবে শিবগঞ্জ উপজেলার সাত গ্রামের কৃষকদের মাঝে ক্ষোভ ও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে।

বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নের সন্ন্যাসী ধোন্দাকোলা গ্রামের প্রান্তিক কৃষক গজেন সরকার (৫৭)। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া দুই বিঘা আয়তনবিশিষ্ট জমিটুকুই সম্বল তাঁর। চার ফসলি এই জমিটুকু চাষাবাদ করে পরিবারের সাত সদস্যের পেটে ভাত জোটে।

শুধু গজেন সরকার নন; এলাকার ১ হাজার ৫০০ বিঘা চার ফসলি জমি অধিগ্রহণ করে সেখানে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পপার্ক স্থাপনের জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। তবে বিষয়টি জানাজানির পর পৈতৃক জায়গাজমি হারানোর শঙ্কায় দিশেহারা শিবগঞ্জ উপজেলার হাজারো কৃষক।

শিল্পপার্কের জন্য অধিগ্রহণ ঠেকাতে ইতিমধ্যেই এলাকাবাসী ‘কৃষি জমি রক্ষা আন্দোলন কমিটি’ গঠন করেছেন। গজেন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘জান দেব, বুকের রক্ত দেব। তবু জীবিকার অবলম্বন এই জমি অধিগ্রহণ করতে দিব না।’

শিল্পপার্কের জন্য অধিগ্রহণ ঠেকাতে ইতিমধ্যেই এলাকাবাসী ‘কৃষি জমি রক্ষা আন্দোলন কমিটি’ গঠন করেছেন

ফসলি জমিতে শিল্পপার্ক স্থাপনের প্রতিবাদে গত মঙ্গলবার শিবগঞ্জের কয়েক গ্রামের হাজারো নারী–পুরুষ পৈতৃক ভিটেমাটি রক্ষার দাবিতে মোকামতলা-জয়পুরহাট আঞ্চলিক সড়কের উথলী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও সমাবেশ করেন। কৃষকদের অভিযোগ, শিল্পপার্কের জন্য প্রস্তাব করা এলাকার এসব জমিতে আগাম আলু, মরিচ, কলা, ফুলকপি, বাঁধাকপিসহ হরেক সবজি চাষ হয়। সাথি ফসল হিসেবে চাষাবাদ হয় আদা, হলুদ, ধনেপাতাসহ নানা ফসল। কিন্তু চার ফসলি এসব জমিকে এক ফসলি উল্লেখ করে সেখানে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পপার্ক স্থাপনে অধিগ্রহণের প্রস্তাব করেছে বিসিক।

বিসিক সূত্রে জানা গেছে, বগুড়ায় ১ হাজার ৫০০ বিঘা আয়তনের একটি কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পপার্ক স্থাপনের জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পাঠিয়েছে বিসিক। এ বছরের ২ মার্চ পাঠানো এই প্রকল্প প্রস্তাবে শিবগঞ্জ উপজেলার উথলী, নারায়ণপুর, সন্ন্যাসী ধোন্দাকোলা, চানপুর, খালিমপুর ও হরিরামপুর মৌজায় ১ হাজার ৫০০ বিঘা জমি এক ফসলি উল্লেখ করে সেখানে শিল্পপার্ক স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে। চার ফসলি জমিতে শিল্পপার্ক স্থাপনের বিষয়টি জানাজানির পর এলাকার সাত গ্রামের কৃষকদের মাঝে ক্ষোভ ও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। ফসলি জমিতে শিল্পপার্ক স্থাপনে আপত্তি জানিয়ে প্রথমে কৃষকেরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) স্মারকলিপি দেন।

গত মঙ্গলবার সরেজমিন উথলী, সন্ন্যাসী ধোন্দাকোলা, নারায়ণপুর, চানপুর, সোলাইমান, গণেশপুর ও হরিরামপুর গ্রাম ঘুরে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কৃষিজমিতে শিল্পপার্ক স্থাপনের খবরে দিশেহারা ও ক্ষুব্ধ কৃষকেরা।

সন্ন্যাসী ধোন্দাকোলা গ্রামের কৃষক মোজাম্মেল খলিফা (৭০) বলেন, আট বিঘার পৈতৃক জমিতে চাষাবাদ করে তাঁর সংসার চলে। এখানে শিল্পপার্ক হলে তাঁকে ছয় বিঘা জমি ছেড়ে দিতে হবে। এই জমিটুকু সরকার নিলে তাঁকে না খেয়ে মরতে হবে।

সন্ন্যাসী ধোন্দাকোলা গ্রামের স্বপন সরকার (৪০) বলেন, তাঁর তিন বিঘা জমি চাষাবাদ করে সংসার চলে। এখানে শিল্পপার্ক হলে তিনি নিঃস্ব হবেন।

সন্ন্যাসী ধোন্দাকোলার সুশান্ত মণ্ডল বলেন, ‘জান দেব, তবু জমি দিব না।’

সন্ন্যাসী ধোন্দাকোলা গ্রামের কৃষক শুকুর আলীর সম্বল বলতে আড়াই বিঘা জমি। সেই জমিটুকু অধিগ্রহণের খবরে তিনি দিশেহারা।

সন্ন্যাসী ধোন্দাকোলার কৃষক প্রশান্ত চন্দ্র বলেন, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে বিঘা দুয়েক জমি কিনেছি। সেই জমি চাষাবাদ করে সংসারের পাঁচজনের মুখে ভাত জোটে।

কৃষি জমি রক্ষা আন্দোলন কমিটির সম্পাদক শাহী সানোয়ার বলেন, ‘বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে হলেও বাপ–দাদার চার ফসলি পৈতৃক এই সম্পত্তি কৃষকেরা রক্ষা করবেন।’ বগুড়ার বিসিকের উপমহাব্যবস্থাপক মো. জাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘বিসিক যেখানে চাইবে, সেখানেই শিল্পপার্ক হবে। এখানে কৃষকের বিরোধিতার কী আছে? বরং সেখানে শিল্পপার্ক হলে কৃষকেরাই উপকৃত হবেন। মানুষের কর্মসংস্থান হবে। কৃষকেরা চার ফসলি জমি দাবি করতেই পারেন, তাঁদের বিরোধিতায় কিছু যায় আসে না।’