জামালপুরে সড়ক নির্মাণের চার মাসেই ধস

সড়কটি গত মে মাসে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। সড়ক নির্মাণে ব্যয় হয় ১২ কোটি টাকা।

জামালপুর পৌর শহরের পুরোনো ফেরিঘাট থেকে ফৌজদারি মোড় পর্যন্ত পৌনে ৪ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে ব্যয় হয় ১২ কোটি টাকা। পাঁচ মাস পার হতে না–হতেই নানা অংশে ধসে গেছে সড়কটি
প্রথম আলো

জামালপুর পৌর শহরের পুরোনো ফেরিঘাট থেকে ফৌজদারি মোড় পর্যন্ত সড়কটি গত মে মাসে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। চার মাস না যেতেই সড়কের ৫০টি জায়গা ধসে গেছে। ফাটল ধরেছে আরও কিছু অংশে। অথচ এ পৌনে ৪ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে ব্যয় হয় ১২ কোটি টাকা।

জামালপুর জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ফারহান আহম্মেদ, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সোহরাব হোসেন ও দপ্তর সম্পাদক আসাদুজ্জামান আকন্দ সাব–কন্ট্রাক্টর হিসেবে সড়ক নির্মাণের কাজটি করেন। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে কাজ করায় উদ্বোধনের চার মাসের মধ্যে সড়কের বিভিন্ন স্থান ভেঙে গেছে।

গত শনিবার দুপুরে দেখা যায়, সড়কটি ব্রহ্মপুত্র তীরঘেঁষা। শহরের পুরোনো ফেরিঘাট থেকে ফৌজদারি মোড় পর্যন্ত গেছে। পুরোনো ট্রাকস্ট্যান্ডের সামনে বিশাল আকারে সড়কটি ধসে গেছে। এই স্থানের ১০০ মিটারের মধ্যেই চারটি স্থানে সড়ক ধসে গেছে। পালপাড়া এলাকার অংশেও ছোট–বড় অসংখ্য স্থানে ধস। বায়তুল আমান জামে মসজিদের সামনে বিশাল আকারের ধস। ভাঙার মধ্যে লাল কাপড় দিয়ে খুঁটি লাগানো হয়েছে। ভাঙা অংশটুকু সড়কের মাঝখান পর্যন্ত চলে গেছে। সড়কের উত্তর পাশ দিয়ে শুধু ইজিবাইক চলাচল করছে। ঢাকাইপট্টি এলাকায় ফুটপাতের টাইলসসহ ধসে গেছে সড়ক।

উদ্বোধনের পরপরই সড়কটি বৃষ্টির পানিতে প্রায় ৫০–৬০টি স্থানে ভেঙে গেছে। এই সড়ক নির্মাণে সরকারি অর্থ লুটপাটের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে।
জাহাঙ্গীর সেলিম, সাধারণ সম্পাদক, জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, আগে থেকেই সড়কের উত্তর পাশে পাউবোর বাঁধ নির্মাণ করা ছিল। দক্ষিণ পাশে ছিল না। নদে ড্রেজার বসিয়ে সড়কটি বালু দিয়ে ভরাট করা হয়। ওই বালুর ওপর খোয়া ফেলা হয়েছিল। তারপর পিচঢালাই করা হয়। ফলে এত অল্প সময়ের মধ্যেই পুরো সড়কটির উত্তর পাশ দিয়ে ধসে গেছে। এ ছাড়া সড়কে কিছুদূর পরপর বৈদ্যুতিক খুঁটিতে বাতি লাগানো হয়েছিল। কিন্তু বেশির ভাগ বাতি এখন বিকল হয়ে গেছে।

সড়কটির কিছু অংশ শেরপুরের চরপক্ষীমারি ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে। ওই ওয়ার্ডের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, সড়কটি যখন নির্মাণ করা হয়েছিল তখন বালু ও নালার পচা মাটি দিয়ে নিচের অংশ ভরাট করা হয়েছিল। মাটি ঠিকমতো না বসিয়েই তার ওপর দিয়ে পিচঢালাই করা হয়েছে।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী অধিদপ্তর (এলজিইডি) জামালপুর কার্যালয় সূত্র জানায়, জামালপুর পৌর শহরের উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় এ পৌনে ৪ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হয়। ৬ কোটি ৪৩ হাজার টাকায় ১ হাজার ৮০০ মিটার সড়কের কাজ পায় মেসার্স ভাওয়াল কনস্ট্রাকশন নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তবে সাব–কন্ট্রাক্টর হিসেবে কাজটি করেন জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ফারহান আহম্মেদ। ৫ কোটি ৬৩ লাখ টাকায় ২ হাজার মিটার সড়কের কাজ পায় মেসার্স আকরাম এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তবে সাব–কন্ট্রাক্টর হিসেবে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সোহরাব হোসেন ও দপ্তর সম্পাদক আসাদুজ্জামান আকন্দ কাজটি করেন। ২০১৬ সালের ৫ ডিসেম্বর কাজটি শুরু হয়। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে সড়কের পিচঢালাই করা হয়। গত ১৪ মে সড়কটি যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেরামত করতে বাধ্য। না হলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মোহাম্মদ মোখলেছুর রহমান, এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী

এলজিইডি কর্তৃপক্ষ জানায়, কাজের চুক্তি অনুযায়ী কাজ শেষ হওয়ার সময় থেকে আগামী এক বছর সড়কটির কোথাও ক্ষতিগ্রস্ত হলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সেগুলো মেরামত করতে বাধ্য থাকবে। কিন্তু গত কয়েক মাসে ওই দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ভাঙা অংশ ও ৩৩টি বৈদ্যুতিক খুঁটি মেরামতের জন্য দুবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ ১৯ আগস্ট চিঠি দেওয়া হয়। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সাব–কন্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করছেন। ফলে তাঁরা কর্তৃপক্ষের চিঠির কোনো তোয়াক্কা করছেন না। সাব–কন্ট্রাক্টররা স্থানীয় প্রভাবশালী হওয়ায় তাঁরা (কর্মকর্তা) বেকায়দায় পড়ে যান।

সাব–কন্ট্রাক্টর ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সোহরাব হোসেন বলেন, এই কাজে কোনো ধরনের অনিয়ম হয়নি। নদের ধারে হওয়ায় এই কাজ করতে গিয়ে তাঁদের লোকসান হয়েছে। বহুবার সড়কটি মেরামত করতে হয়েছে।

জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ফারহান আহম্মেদ বলেন, সড়কের এক পাশের বাঁধ থাকলেও অন্য পাশে ছিল না। আর চুক্তি অনুযায়ী মেরামতের সময়সীমা অনেক আগেই শেষ হয়েছে।

জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, উদ্বোধনের পরপরই সড়কটি বৃষ্টির পানিতে প্রায় ৫০–৬০টি স্থানে ভেঙে গেছে। এই সড়ক নির্মাণে সরকারি অর্থ লুটপাটের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে সদ্য নির্মিত সড়কটি পুরো বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।

এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মোখলেছুর রহমান বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেরামত করতে বাধ্য। না হলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।