মাগুরায় সরকারি তহবিল থেকে প্রায় ৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ

মৃত ও অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যসহ বিভিন্ন নাম ব্যবহার করে জিপিএফ ও নিরাপত্তা জামানত ফান্ড থেকে এই অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর সঙ্গে পুলিশের কিছু সদস্যের পাশাপাশি জেলা হিসাবরক্ষণ ও ফিন্যান্স কর্মকর্তার কার্যালয় এবং সোনালী ব্যাংকের একটি সঙ্গবদ্ধ একটি চক্র জড়িত আছে বলে ধারণা করছে পুলিশ।

প্রতীকী ছবি

মাগুরায় জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারি তহবিল থেকে প্রায় ৯ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রায় চার বছর ধরে পুলিশ সদস্যসহ কয়েকজন ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে এই অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটে আসছে বলে খবর পাওয়া গেছে। বিষয়টি নিয়ে জেলা হিসাবরক্ষণ ও ফিন্যান্স কর্মকর্তার কার্যালয় এবং জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে আলাদা দুটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে যশোরের দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে।

মাগুরা পুলিশ সুপার কার্যালয় এবং জেলা হিসাবরক্ষণ ও ফিন্যান্স কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ পুলিশের সাধারণ ভবিষ্য তহবিল (জিপিএফ) ও নিরাপত্তা জামানত (ডিপোজিট অ্যাগেইনস্ট ওয়ার্কস অ্যান্ড সাপ্লাই)—এ দুটি তহবিল থেকে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। আজ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ তদন্তে পাঁচটি হিসাবে এই অর্থ গেছে বলে জানতে পেরেছে পুলিশ। এর মধ্যে তিনটি হিসাব জেলা পুলিশের তিন সদস্যের নামে। সন্দেহভাজন ওই তিনজন হলেন জেলা পুলিশের কনস্টেবল গাজী মসিউর রহমান, মো. ফিরোজ হোসেন ও শিপন মৃধা। এর মধ্যে গাজী মসিউর রহমান পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে ক্যাশ সরকার (পুলিশ সদস্যদের বেতন, ভাতা ও অন্যান্য বিল–ভাউচার জমা দেওয়া ও উত্তোলনের কাজ করেন) হিসেবে জেলা হিসাবরক্ষণ ও ফিন্যান্স কর্মকর্তার কার্যালয়ে নিযুক্ত ছিলেন। ফিরোজ হোসেন পুলিশ সুপার কার্যালয়ে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। শিপন মৃধা মসিউর রহমানের আত্মীয়।

প্রাথমিক তদন্তে আরও যে দুটি হিসাবের খোঁজ পাওয়া গেছে, সে দুজন হলেন মো. আজমল মুন্সী ও রুকাইয়া ইয়াসমিন বিচিত্রা। পুলিশ বলছে, মো. আজমল মুন্সী নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার বাসিন্দা। একই এলাকায় বাড়ি কনস্টেবল গাজী মসিউর রহমানের। আর রুকাইয়া ইয়াসমিন বিচিত্রা নামে ব্যাংক হিসাব খোলার সময় মাগুরা পৌর এলাকার সাজিয়াড়া গ্রামের ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে।

প্রাথমিকভাবে যে ১৫টি চেক উদ্ধার করা গেছে, তাঁর অনেকগুলো চেকের তথ্য ও অ্যাডভাইসের তথ্য মিলছে না। সে ক্ষেত্রে ব্যাংক থেকে এগুলো ফেরত পাঠানোর কথা। তবে তা করা হয়নি। পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে ম্যানুয়ালি বিল দেওয়ার কথা থাকলেও এ ক্ষেত্রে অনলাইনে বিল পাঠানো হয়েছে।
সরকার রফিকুল ইসলাম, মাগুরা জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা

পুলিশ সুপারের কার্যালয় সূত্র বলছে, মো. আজমল মুন্সী নামের হিসাবের মাধ্যমেই পাঁচ কোটি টাকার বেশি উত্তোলন করা হয়েছে। মাগুরা সোনালী ব্যাংকে হিসাবটি খোলা হয় ২০১৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। হিসাবে পরিচয়দানকারী হিসেবে আছেন তৎকালীন পুলিশ সুপার মো. মনিবুর রহমানের নাম। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে ওই কর্মকর্তার সই জাল করেই হিসাবটি খোলা হয়। সব মিলিয়ে গত চার বছরে কয়েকটি হিসাবে ৯ কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। আত্মসাৎ হওয়া অর্থের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা তাদের।

মাগুরার পুলিশ সুপার খান মুহাম্মদ রেজোয়ান প্রথম আলোকে জানান, ২ ডিসেম্বর পুলিশের একটি অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সূত্র বিষয়টি প্রথমে অবহিত করে। এরপর তদন্ত করে দেখা যায়, মৃত ও অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যসহ বিভিন্ন নাম ব্যবহার করে জিপিএফ ও নিরাপত্তা জামানত ফান্ড থেকে এই অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। যার সঙ্গে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের তিন সদস্য জড়িত আছে বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে। এই অর্থ উত্তোলনের প্রক্রিয়া হচ্ছে, পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে বিল দাখিল করতে হয় জেলা হিসাবরক্ষণ ও ফিন্যান্স কর্মকর্তার কার্যালয়ে। এরপর কয়েক দফা যাচাই–বাছাই শেষে অর্থ নির্দিষ্ট হিসাবে জমা হয়। তবে দেখা গেছে, এই চেকগুলোর ক্ষেত্রে পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে কোনো বিল দাখিল করা হয়নি। এর সঙ্গে পুলিশের কিছু সদস্যের পাশাপাশি জেলা হিসাবরক্ষণ ও ফিন্যান্স কর্মকর্তার কার্যালয় এবং সোনালী ব্যাংকের একটি সঙ্গবদ্ধ একটি চক্র জড়িত আছে বলে ধারণা করছেন তিনি।

জেলা হিসাবরক্ষণ ও ফিন্যান্স কর্মকর্তার কার্যালয় অবশ্য দাবি করছে, ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে পুলিশের কনস্টেবল গাজী মসিউর রহমান অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটিয়েছেন। পুলিশের ওই কনস্টেবল চেকের পাতা চুরি করে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার সই নকল করে এই অপকর্ম করেছেন বলে দাবি তাঁদের। জেলা হিসাবরক্ষণ ও ফিন্যান্স কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, গত ৩০ নভেম্বর কার্যালয় থেকে চেকের দুটি পাতা হারিয়ে যাওয়ার পর বিষয়টি তাদের নজরে আসে। এরপর খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুলিশের কনস্টেবল মসিউর রহমান চেক দুটি নিয়ে গেছেন। এরপর ওই দুটি ছাড়াও অনুরূপ ১৫টি চেকের সন্ধান পেয়েছে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয়। যেগুলোর মাধ্যমে ২ কোটি ৮৯ লাখ টাকার বেশি হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।

এ ঘটনায় ব্যাংকের কারও জড়িত থাকার সুযোগ নেই। যাচাই–বাছাই করে দেখা গেছে, এখান থেকে কোনো ভুল হয়নি। বিষয়টি তদন্তে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
মো. রাশিদুল ইসলাম, এজিএম, মাগুরা সোনালী ব্যাংক

জেলা হিসাবরক্ষণ ও ফিন্যান্স কর্মকর্তার কার্যালয় এবং সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই অর্থ উত্তোলনের প্রক্রিয়া হচ্ছে, প্রথমে পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে একটি বিল জেলা হিসাবরক্ষণ ও ফিন্যান্স কর্মকর্তার কার্যালয়ে জমা দিতে হয়। এরপর জেলা হিসাবরক্ষণ ও ফিন্যান্স কর্মকর্তার কার্যালয়ের একজন নিরীক্ষক বিলটি যাচাই–বাছাই করে রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ করে একাধিক কর্মকর্তার সই–সংবলিত একটি চেক ইস্যু করেন। একই সঙ্গে সেই চেকের তথ্য–সংবলিত একটি অ্যাডভাইস অনলাইনে পাঠাতে হয় ব্যাংকে। চেকের তথ্য ও অ্যাডভাইস লেটারের তথ্য মিললে তবেই নির্দিষ্ট হিসাবে অর্থ ছাড় করে ব্যাংক। এরপর ওই চেক আবার ব্যাংক থেকে ফেরত পাঠানো হয় জেলা হিসাবরক্ষণ ও ফিন্যান্স কর্মকর্তার কার্যালয়ে।

জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা সরকার রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিকভাবে যে ১৫টি চেক উদ্ধার করা গেছে, তাঁর অনেকগুলো চেকের তথ্য ও অ্যাডভাইসের তথ্য মিলছে না। সে ক্ষেত্রে ব্যাংক থেকে এগুলো ফেরত পাঠানোর কথা। তবে তা করা হয়নি। পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে ম্যানুয়ালি বিল দেওয়ার কথা থাকলেও এ ক্ষেত্রে অনলাইনে বিল পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘চেক চুরি করে, স্বাক্ষর জাল করে, অডিটরদের (নিরীক্ষক) কম্পিউটারের ইউজার নেম পাসওয়ার্ড হ্যাক করে এই জালিয়াতি করা হয়েছে বলে আমরা ধারণা করছি।’ এর সঙ্গে পুলিশ সদস্যের পাশাপাশি ব্যাংকের কেউ এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে বলে অভিযোগ তাঁর। তিনি জানান, এ ঘটনায় দুদকে একটি সাধারণ ডায়েরি করার পাশাপাশি চুয়াডাঙ্গার জেলা হিসাবরক্ষণ ও ফিন্যান্স কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে।

অবশ্য ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মাগুরা সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তারা। মাগুরা সোনালী ব্যাংকের এজিএম মো. রাশিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় ব্যাংকের কারও জড়িত থাকার সুযোগ নেই। তাঁরা যাচাই–বাছাই করে দেখেছেন এখান থেকে কোনো ভুল হয়নি। বিষয়টি তদন্তে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

যশোরের দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক নাজমুস সাদাত মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় মাগুরা হিসাবরক্ষণ ও ফিন্যান্স কর্মকর্তার কার্যালয় এবং মাগুরা পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে দুটি জিডি করা হয়েছে। জিডির কপি ও এই সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র ঢাকায় কমিশনের প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে বিষয়টি তদন্তের অনুমতি পেলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।