জুমখেত পুড়িয়ে দেওয়ার পর সেই তিন পাহাড়ি পাড়ায় খাদ্যসংকট

বান্দরবানের লামায় জুমচাষের প্রাকৃতিক বনাঞ্চল পুড়িয়ে দিয়েছে রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানিছবি: প্রথম আলো

বান্দরবানের লামায় জুমচাষের প্রাকৃতিক বনাঞ্চল পুড়িয়ে দেওয়ায় তিনটি পাড়ার ম্রো ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মানুষ খাদ্যসংকটে দিন কাটাচ্ছেন বলে জানা গেছে। অনেক পরিবার একবেলা খেয়ে এবং কিছু পরিবার তিন-চার দিন ধরে জঙ্গলের আলু ও লতাপাতা খেয়ে দিন যাপন করছেন বলে জানিয়েছেন। পাড়ার বনাঞ্চল পুড়িয়ে দেওয়ার কারণে গাছ-বাঁশ সংগ্রহ করে বিক্রি করতে না পারা এবং দিনমজুরির কাজ না থাকায় তাঁরা সংকটে পড়েছেন বলে লাংকমপাড়ার কার্বারি (পাড়াপ্রধান) লাংকম ম্রো আজ বুধবার জানিয়েছেন।

রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানি নামের একটি প্রতিষ্ঠান গত ২৬ এপ্রিল লাংকমপাড়া, রেংয়েনপাড়া ও জয় চন্দ্রপাড়ার ৪০০ একর জুমচাষের নবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক বনাঞ্চল থেকে ৩৫০ একর কেটে পুড়িয়ে দিয়েছে। এ ঘটনায় কোম্পানি ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ আটজনের বিরুদ্ধে করা মামলায় স্থানীয় ব্যবস্থাপকসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

পাড়াবাসী জানিয়েছেন, প্রতিবছর বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে এলাকায় দিনমজুরির কাজ না থাকলে তাঁদের অভাব দেখা দেয়। তখন তাঁরা বনাঞ্চলের মুলিবাঁশ ও গাছ সংগ্রহ করে বিক্রি করে সংকট দূর করেন। কিন্তু এবার বনাঞ্চল পুড়ে যাওয়ায় একদিকে দিনমজুরির কাজ নেই, অন্যদিকে গাছ-বাঁশও সংগ্রহ করতে পারছেন না। বনাঞ্চল পুড়ে দেওয়ার সময় সংগ্রহ করে রাখা ১০ হাজার বাঁশও পুড়ে গেছে। এ জন্য তিন পাড়ার প্রতিটি পরিবার অনাহারে-অর্ধাহারে দিন যাপন করছে।

লাংকমপাড়ায় এক কক্ষের ছোট ঝুপড়িতে থাকা চংরাউ ম্রো জানালেন, রোববার থেকে পাঁচ বছরের মেয়ে ও তিন বছরের ছেলেকে ভাত খাওয়াতে পারছেন। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী জঙ্গলের আলু ও লতাপাতা খেয়ে আছেন।

একই অবস্থা রেংচ্যং ম্রোর পরিবারেরও। রেংচ্যং বলেন, দিনমজুরির কাজ নেই। ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) থেকে ঈদের আগে ত্রিপুরাপাড়ার পাঁচ পরিবারকে চাল দিলেও তাঁদের কোনো কিছু দেওয়া হয়নি।

কার্বারি (পাড়াপ্রধান) লাংকম ম্রো জানালেন, পাড়ায় রেংচ্যং ও চংরাউ ম্রো সবচেয়ে অসহায়। অন্য পরিবারগুলো কিছু ভাত, কিছু জঙ্গলের আলু ও শাকসবজি খেয়ে আপাতত দিন পার করছে। তিনি বলেন, তাঁর পাড়া (লাংকমপাড়া), জয়চন্দ্রপাড়া ও রেংয়েনপাড়ার ৩৯টি পরিবারের মধ্যে ঈদের আগের দিন ১২টি পরিবার ১০ কেজি করে চাল পেয়েছে। এ ছাড়া পাড়াবাসীর বনাঞ্চল, বাগান, ধানের জমি পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা এখনো সরকারি-বেসরকারি থেকে কোনো ক্ষতিপূরণ বা ত্রাণ পাননি।

লামা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে সরই ইউনিয়নের লাংকমপাড়ায় ১০টি, রেংয়েনপাড়ায় ১৩টি ও জয় চন্দ্রপাড়ায় ১৬টি পরিবারের বসবাস। তাঁরা ম্রো ও ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর সদস্য। বাঁশের তৈরি ছোট ছোট ঝুপড়িতে থাকা প্রতিটি পরিবার খুবই দরিদ্র। প্রভাবশালীদের রাবার ও একাশিয়া বাগানে ঘেরা পাড়ার জুমবাম (পাড়ার জুমচাষের প্রাকৃতিক বনাঞ্চলকে জুমবাম বলা হয়) পুড়িয়ে দিয়েছে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানি। বননির্ভর পাড়াবাসী সম্পূর্ণ ওই জুমবামের বনাঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল। সেখানে তাঁরা জুমচাষ করেন, গাছ, বাঁশ সংগ্রহ করে বিক্রি করেন।

সরই ইউপির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেছেন, ঈদ উপলক্ষে কিছু চাল সেখানে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওই পাড়াবাসীর অনাহারে-অর্ধাহারে থাকার বিষয়টি তাঁকে জানানো হয়নি।

লামার তিন পাড়ার মানুষের জুমের জমি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে
ছবি: প্রথম আলো

লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ মোস্তফা জাবেদ কায়সার বলেছেন, জনপ্রতিনিধি এবং পাড়াবাসীর পক্ষ থেকে খাদ্যসংকটের কিছু জানানো হয়নি। খোঁজ নিয়ে তিনি দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন।

সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি করার জন্য রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানির কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন জয়চন্দ্রপাড়া ও লাংকমপাড়ার দুই কার্বারি জয়চন্দ্র ত্রিপুরা ও লাংকম ম্রো।

তাঁরা বলছেন, কোম্পানির আগুনে শুধু ৩৫০ একর পাড়াবামের প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ধ্বংস হয়নি। একই সঙ্গে কলাবাগান, ফলদ-বনজ বাগান, ধানের খেতও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে পাড়াবাসীর জীবন-জীবিকার মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। এসবের ক্ষতিপূরণ অবশ্যই কোম্পানিকে দিতে হবে।