জে ডি ওয়ার্ড থেকে খোরশেদ আলম—এরপর কে?

১৮৬৪  থেকে ২০২১ সাল। জে ডি ওয়ার্ড থেকে খোরশেদ আলম সুজন। এরপর কে? ১৫৭ বছরের দীর্ঘ যাত্রা শেষে চট্টগ্রামবাসীর মনে এই প্রশ্ন? কে আসছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র হয়ে। এ নিয়ে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার শেষ নেই চট্টগ্রামবাসীর।

১৮৬৪ সালে চট্টগ্রাম শহরের উপযোগিতা অনুভব করে এর উন্নতির জন্য ব্রিটিশ সরকার চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটি গঠন করে এর প্রশাসকের দায়িত্ব দেন তখনকার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট জে ডি ওয়ার্ডকে। এখনো সরকার নির্বাচিত একজন প্রশাসক নিয়োজিত আছেন। উপনিবেশকালে যাত্রা শুরুর সময় প্রশাসক, আর স্বাধীন বাংলাদেশে প্রশাসক নিয়োগের প্রেক্ষাপট ও কারণের মধ্যে বিস্তর ফাঁরাক। এর মধ্যে কোনো কাকতালীয় যোগাসূত্র নেই। তবে সর্বশেষ প্রশাসকের হাত থেকে কোন প্রার্থী মেয়রের দায়িত্ব নেবেন, এই প্রশ্ন এখন মানুষের মনে।

চট্টগ্রামে শুরুতে মিউনিসিপ্যালিটির প্রধান দায়িত্ব ছিল পাবলিক ল্যাট্রিনের ব্যবস্থা করা। এখন করপোরেশনের কর্মপরিধি অনেক বিস্তৃত। সে সময় চট্টগ্রামে ওয়ার্ড ছিল চারটি। এখন ৪১টি। ১৯২০ সালে চৌধুরী শ্রীপূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা তত্ত্বনিধি রচিত ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস’ বইয়ে তখনকার চার বর্গমাইল এলাকার চট্টগ্রামের লোকসংখ্যা ২৯ হাজার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এই ২০২১ সালে ১৬০ দশমিক ৯৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে ভোটার আছেন ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৬ জন।

চট্টগ্রাম ইতিহাস ও সিটি করপোরেশনে রক্ষিত বিভিন্ন তথ্য থেকে আমরা জানতে পারি, ১৮৬৪ সাল থেকে ১৯১৫ পর্যন্ত চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটির কার্যক্রম পরিচালিত হতো প্রশাসকের মাধ্যমে। ১৯১৬ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেছেন ইংরেজরা। সে বছর প্রথম চেয়ারম্যান হন একজন বাঙালি। তিনি খান বাহাদুর আমান আলী। ১৯১৯ সালে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটির প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন খান বাহাদুর আবদুস সাত্তার। এরপর একে একে নুর আহম্মদ, রফিকুদ্দিন আহমদ সিদ্দিকী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৮ সালে আবার শুরু হয় প্রশাসক নিয়োগ। স্বাধীনতার পর মিউনিসিপ্যালিটির প্রশাসক নিযুক্ত হন মোহাম্মদ হোসাইন।

১৯৭৩ সালে আবার সরাসরি ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচতি হন ফজল করিম। ফজল করিম টানা ১০ বছর ১৯৮২ সাল পর্যন্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২ সালেই চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটি চট্টগ্রাম পৌর করপোরেশনে রূপান্তরিত হয়। তখন থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত নবগঠিত পৌর করপোরেশন সরকার নিয়োজিত প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে চলত। ১৯৮৯ সালে পৌর করপোরেশনটি সিটি করপোরেশনে রূপান্তরিত হয়। এরপর মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী, ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বিএনপি নেতা মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৪ সাল থেকে মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, মোহাম্মদ মনজুর আলম, আ জ ম নাছির উদ্দীন।

করোনার কারণে ২০২০ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর সরকার আওয়ামী লীগ নেতা খোরশেদ আলম সুজনকে প্রশাসক নিয়োগ দেয়। তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই আগামী পাঁচ বছরের জন্য মেয়র নির্বাচন করবেন চট্টগ্রাম নগরের মানুষ।

এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ন্যাশনাল পিপলস পার্টির আবুল মনজুর, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের এম এ মতিন, স্বতন্ত্র খোকন চৌধুরী, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের মুহাম্মদ ওয়াহেদ মুরাদ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. জান্নাতুল ইসলাম, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মো. রেজাউল করিম চৌধুরী, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) শাহাদাত হোসেন।

গত দেড় শতাব্দীর বেশি সময়ে এই নগরের উন্নতি হয়েছে। এর বিস্তার ঘটেছে বহুগুণ।

লোকসংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে ব্যবসা–বাণিজ্য, নানা ধরনের শিল্পকারখানা। বেড়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ। চট্টগ্রাম বন্দরের ক্ষমতা ও কার্যক্রমও ব্যাপক হয়েছে। ফলে গুরুত্ব ও কদর বেড়েছে সবদিক দিয়ে। এসব প্রাপ্তির পাশাপাশি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের অনেক কিছু আমাদের হারাতে হয়েছে। চৌধুরী শ্রীপূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা তত্ত্বনিধির বইতে লেখা আছে, ‘চট্টগ্রাম পর্ব্বতময় প্রদেশ। এই সহরে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে অনেকগুলি ঝরনা ছিল, উক্ত ঝরনা হইতে আপনা–আপনি ভুগর্ভ হইতে দিনরাত জল উঠিত এবং উক্ত জল অতি পরিষ্কার ও মিষ্ট।’ বলাই বাহুল্য, প্রকৃতির সেই অকৃপণ দান আমরা হারিয়ে ফেলেছি। শুধু ঝরনা নয়, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা হাজার হাজার দালানের এই শহরে, অলিগলির ধূলিধূসরিত এই নগরে, জলাবদ্ধ এই সিটি করপোরেশনের এলাকায় আমরা আরও বহু কিছু হারিয়েছি।

হারিয়েছি পাহাড়, বহু প্রাকৃতিক জলধারা, খাল, বনাঞ্চল, উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য।

২৭ জানুয়ারির নির্বাচনে দেড় শত বছরের পুরোনো এই প্রতিষ্ঠানের যিনি দায়িত্ব পাবেন, তিনি হারিয়ে ফেলা সম্পদগুলো উদ্ধার করতে পারবেন না। কিন্তু আমরা যাতে আর কিছু না হারাই, সেটার জন্য হয়তো কাজ করতে পারেন। কারণ, যুগ যুগ ধরে হারাতে হারাতে এখনো আমাদের অনেক আাছে। ‘সাগরকুন্তলা’ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে চারটি ওয়ার্ডের একপাশে নদী, একপাশে সাগর, ৮টি ওয়ার্ডের পাশে সাগর আছে, নদী আছে ১৩টি ওয়ার্ডের পাশে। এখনো অনেক পাহাড় বর্তমান, হ্রদও আছে। বহু প্রান্তর ঘুরে এসে এক নদী এই শহরের প্রান্তে একটি সাগরের সঙ্গে মিশে গেছে। নদীও সাগরের এমন মিলন, এমন হ্রদের আর পাহাড়ের শহর পৃথিবীতে কয়টা আছে?