জেগে আছেন বাংলা মাটিতে

কবিয়াল রমেশ শীল

আজ থেকে ১২৩ বছর আগের ঘটনা। ঘটনাস্থল ফিরিঙ্গীবাজারের মাঝিরঘাট। আশ্বিন মাস। দুর্গাপূজার জমজমাট আয়োজন। সেকালের জমজমাট মেলা বা কোনো আনন্দ–উৎসবে কবিগান ছিল এক অনিবার্য বিষয়। এ ছাড়া কোনো আসর জমত না। সে বারেও কবিগানের আয়োজন ছিল। তখনকার জনপ্রিয় কবি মোহনবাঁশি ও চিন্তাহরণকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। চারদিকে মাইকে প্রচার করা হয়েছে। অধীর আগ্রহে শ্রোতা দর্শকেরা অপেক্ষা করছে। সবই ঠিকঠাক। কবিগানের লড়াই শোনার জন্য হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছেন। কিন্তু হঠাৎই ঘটল এক বিপত্তি। অসুস্থ হয়ে পড়লেন চিন্তাহরণ। শ্রোতারা হতাশ। তাৎক্ষণিকভাবে আয়োজকেরা আরেক জনপ্রিয় কবি দীনবন্ধু মিত্রকে আসতে অনুরোধ করলেন। তিনি আসতে রাজি হলেন না। তবে আসরের জন্য এক নবীন কবিকে পাঠালেন। বয়স মাত্র ২১। এত মানুষের সামনে, এত বড় এক কবির সঙ্গে তিনি কি পারবেন? ভয়ে তাঁর বুক কাঁপলেও শেষ পর্যন্ত উঠে গেলেন মঞ্চে।

তরুণকে দেখে অবজ্ঞার হাসি হেসে মোহনবাঁশি বললেন, ‘এই পুঁচকের সঙ্গে কি পালা করা যায়। উত্তরে সেই তরুণ বিনীতভাবে বলেছিলেন, উৎসব আর ভয়, লজ্জা কম নয়/কে বা হারাতে পারে কারে/পুঁচকে ছেলে সত্যি মানি, শিশু ব্রজ ছিল জ্ঞানী/চেনাজানা হোক না আসরে।

বিনয় অথচ সাহস নিয়ে প্রবীণ কবিয়ালকে জবাব দিয়ে উপস্থিত দর্শকদের চমকে দিয়েছিল যে তরুণ, তাঁর নাম রমেশ শীল। পরবর্তী সময়ে যিনি কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। যাঁর হাত ধরে বাংলা কবিগানের বিষয় আঙ্গিক পাল্টে গিয়েছিল। বাংলা কবিগান এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছিল। সেদিনের আসরে টানা আট ঘণ্টা সবাইকে মাতিয়ে রেখেছিলেন রমেশ শীল। এরপর তাঁর নাম বাতাসে ছড়াতে থাকে। কবিয়াল হিসেবে তাঁর নামটা মানুষের মনের ভেতরে গেঁথে যায়।

কিন্তু রমেশ শীলকে শুধু কবিয়াল বিশেষণে আখ্যায়িত করলে তাঁর মানসচেতনাকে খর্ব করা হবে। তিনি তাঁর প্রতিভাকে কাজে লাগিয়েছেন সংস্কারের কাজে। মানুষের ভাগ্য বদল, বৈষম্যহীন সমাজ গঠন, উপনিবেশের জাঁতাকল থেকে মাতৃভূমিকে মুক্তির স্বপ্নে তিনি পদ রচনা করেছেন, কাজ করেছেন। এসব ভাবনা থেকে তিনি কবিতা লিখতেন। ফলে কবিগানের যে প্রাচীন ভাষা, বিষয় এবং প্রকাশভঙ্গি তিনি পাল্টাতে শুরু করেন। পৌরাণিক কাহিনি বা চরিত্র, দেব-দেবী, রাধা-কৃষ্ণের কাহিনি, নারী-পুরুষ বিতর্ক ইত্যাকার বিষয় নিয়ে তখন কবিগান রচিত হতো, কবিদের মধ্যে ছন্দের লড়াই হতো। সেই লোকায়ত ঐতিহ্যের সঙ্গে রমেশ শীল যুক্ত করলেন তাঁর সময়কে। বাস্তবের মাটিতে মানুষ যে সুখ, দুঃখ নিয়ে জীবন কাটায়। যে ঝড়–জলে, খরা–বন্যায় তার জীবনে দুর্যোগ নেমে আসে, রাষ্ট্রযন্ত্রের যে চালিকাশক্তি মানুষে মানুষে ব্যবধান বাড়িয়ে দেয়, ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের ফলে মানুষের অগ্রগতি যেখানে অচলায়তনে পরিণত হয়েছে, তারই সব বৃত্তান্ত উঠে আসতে লাগল ঐতিহ্যের কবিগানে।

বাংলায় ব্রিটিশ উপনিবেশের গোড়াপত্তনের ইতিকথা কয়েকটি চরণে কবি এভাবে লিখলেন। এমনি ভাবে রঙ্গরসের কবির লড়াই হয়ে উঠল মানুষের চেতনাকে ধারালো করার, মানুষের দৃষ্টিকে সজাগ করার হাতিয়ার। চাষি বনাম মজুতদার, যুদ্ধ বনাম শান্তি, মহাজন বনাম খাতক, স্বৈরতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র, পরাধীনতা বনাম স্বাধীনতা—এসব তর্কই উপজীব্য হয়ে উঠল কবিগানের। দুর্ভিক্ষের সময় অনাহারে যখন মানুষ মরতে লাগল পথে পথে, তিনি লিখলেন—দেশ জ্বলে যায় দুর্ভিক্ষের আগুনে/এখনো লোকে জাগিল না কেনে?

শুধু পদ রচনা করে ক্ষান্ত হননি কবিয়াল রমেশ শীল। সমাজতন্ত্রের আদর্শে উজ্জীবিত কবি মাঠ পর্যায়ে করেছেন সরকারের সব ভয়ভীতিকে তোয়াক্কা না করে। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে, পাকিস্তান আমলে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ছিলেন। ১৯৫৪ সালে জনতার ভোটে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে নূরুল আমিনকে পূর্ববাংলার গভর্নর করা হয়েছিল। নূরুল আমিন তখন চট্টগ্রামে এলে রমেশ শীল ব্যঙ্গ করে একটি গান বেঁধেছিলেন। সেই গান বিপুল জনপ্রিয়তা পায়।

চট্টগ্রামের এই কৃতী পুরুষের জন্ম ১৮৭৭ সালের ৯ মে বোয়ালখালীর গোমদণ্ডী গ্রামে। পিতা চণ্ডীচরণ শীল। রমেশ শীলের শৈশব ছিল পিতৃ হারানোর বেদনায় ভরা আর দারিদ্র৵ক্লিষ্ট জীবন। চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে তিনি হারিয়েছেন তাঁর বাবাকে। ওইটুকুন বয়সে সংসারের সব ভার তার কাঁধে এসে বর্তায়। নিজের সে সময়ের অবস্থার কথা তিনি লিখেছেন এভাবে— আমিই বালক, চালক, পালক, আমার আর কেহ নাই। মায়ের অলংকার সম্বল আমার, বিক্রি করে খাই।

এ রকম এক অবস্থায় পূর্বপুরুষের পেশাকেই বেছে নিলেন রমেশ। মাঝে একবার ভাগ্যবদলের জন্য রেঙ্গুন গিয়ে কাজ করেন। সেখানে তাঁর আর্থিক অবস্থার উন্নতিও হয়েছিল। কিন্তু মাতৃভূমির মায়া তাঁকে আবার দেশে ফিরিয়ে আনে। এসে আবার শুরু করেন পুরোনো পেশার কাজ। পাশাপাশি কবিরাজি শুরু করেন। সেই কবিরাজি করতে করতে, রাতে পালাগান আর কবিগান এসব দেখতে দেখতে, আকৃষ্ট হন আর নিজে চর্চা শুরু করেন। প্রথমে প্রথাগত কবিগান রচনার মাধ্যমে রচনা শুরু করলেও পরে কবিগানের ধরনই পাল্টে দিলেন। তিনি লিখেছেন প্রচুর মাইজভান্ডারি গান।

কবি রমেশ শীলের বিষয়বস্তু শেষ পর্যন্ত ছিল মানুষ। সেই মানুষের সার্বিক মুক্তির স্বপ্নে তিনি কাজ করেছেন, কলম ধরেছেন। তার জন্য তিনি পেয়েছিলেন মানুষের ভালোবাসা। জীবদ্দশায় পেয়েছেন প্রচুর সংবর্ধনা। ১৯৫৮ সালে ঢাকায় কারান্তরীণ থাকা অবস্থায় সহবন্দীরা তাঁকে সংবর্ধিত করেছেন। ১৯৬২ সালে বুলবুল একাডেমি ও ’৬৪ সালে চট্টগ্রামে নাগরিক সংবর্ধনা লাভ করেন তিনি। কিন্তু তিনি কখনো এসব পুরস্কারের তোয়াক্কা করেননি। প্রতিষ্ঠার কাঙাল ছিলেন না, সারা জীবন প্রতিষ্ঠানের প্রতিকূলে কাজ করেছেন সংগ্রামী চেতনায়। দেশকে ভালোবেসেছেন প্রাণ দিয়ে।

এ জন্যই বাংলার মানুষ আজও তাঁকে মনে রেখেছেন। বাংলার মাটিতে রমেশ শীল আরও বহু বছর জেগে থাকবেন।

ওমর কায়সার: কবি ও প্রথম আলোর বার্তা সম্পাদক, চট্টগ্রাম অফিস