জোয়ারে নষ্ট ফসলের খেত

আগাম জোয়ার–বন্যায় জেলার প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমি প্লাবিত হয়েছে। এতে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

ভোলা সদর উপজেলার ভেদুরিয়ার চরে জোয়ারের পানি। ৩০ মার্চের ছবি
প্রথম আলো

জোয়ারের পানিতে কয়েক দিন আগে প্লাবিত হয়েছে কৃষক আনোয়ারুল্যাহর বাঙ্গি ও কুমড়াখেত। লবণাক্ত ওই পানির কারণে এখন গাছের পাতা পুড়ছে এবং ফল পচে যাচ্ছে। মাথা খারাপ হওয়ার দশা তাঁর।

আনোয়ারুল্যাহর বাড়ি ভোলা সদর উপজেলার ভেদুরিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম ভেদুরিয়া গ্রামে। খেতে জোয়ারের পানি প্রবেশ করায় তাঁর অন্তত এক লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। আনোয়ারুল্যাহ বলেন, ‘বলা নাই, কওয়া নাই, বান-তুয়ান বৃষ্টি নাই। পুণ্যিমার পরে আইবো ডালি (পানির স্তর কমে যাওয়া), আইলো জোঁ (জোয়ারে পানির স্তর বেড়ে যাওয়া)। জোয়ার-বন্যায় খেত ডুইব্যা গেছে। কী করুম, এহোনো সার-ওষুদের দাম বাকি।’

গত বুধ ও বৃহস্পতিবার (পূর্ণিমার পরের রাতে) তেতুলিয়া নদীর তীর ও চরাঞ্চলে বিস্তীর্ণ ফসলি খেত জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। সাত উপজেলার কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, আগাম জোয়ার–বন্যায় জেলার প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমি প্লাবিত হয়েছে। এতে অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

এ সম্পর্কে সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন বলেন, গত বছর রবি মৌসুমের শুরু থেকে বর্ষাকাল অবধি বৃষ্টি ছিল। বৃষ্টিতে কৃষকের ক্ষতি হয়েছিল। এ বছর অনাবৃষ্টি। এ খরার মধ্যে হঠাৎ অস্বাভাবিক জোয়ার। পানি উঠে নেমে গেছে, এতে ক্ষতি হতো না, বরং উপকার হতো। কিন্তু পানিতে লবণ থাকার কারণে অরক্ষিত চরের সব ফসল মরে যাচ্ছে।

সদর উপজেলায় ভেলুমিয়া ও ভেদুরিয়া ইউনিয়নে তরমুজ ও বাঙ্গির চাষ হয় বেশি। তেতুলিয়া নদীর মাঝে জেগে ওঠা চর চটকিমারা, কালেঙ্গারচর, করিমুদ্দিন, গাজিরচর, চর হোসেন, নিউ চর হোসেন, চর মোহাম্মদ, চরভেদুরিয়া-পাতা ভেদুরিয়া। আড়তদারেরা আগাম লগ্নি করেন এসব চরের কৃষকদের খেতে। মেঘনা নদীর মাঝে জেগে ওঠা চরেও তরমুজের আবাদ হচ্ছে।

এ ছাড়া বোরহানউদ্দিন উপজেলার গঙ্গাপুর, সাচড়া; লালমোহন উপজেলার ফরাজগঞ্জ, পশ্চিম চরউমেদ, বদরপুর; চরফ্যাশন উপজেলার মুজিবনগর ইউনিয়নগুলো তেতুলিয়া নদী ও সদর উপজেলার রাজাপুর, কাচিয়া; দৌলতখান উপজেলার মদনপুর ইউনিয়ন মেঘনা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত। এসব ইউনিয়নেও তরমুজ ও বাঙ্গির আবাদ হচ্ছে।

গত শুক্র ও শনিবার তেতুলিয়া নদীর তীরবর্তী ও নদীর মধ্যে জেগে ওঠা চরে দেখা যায়, তরমুজ ও বাঙ্গিগাছের পাতা পুড়ে গেছে। শুধু লতা দেখা যায়, ছোট ছোট ফল পচে যাচ্ছে। মাটির রঙ লালচে কালো। মরিচগাছ শুকিয়ে ঢলে পড়ছে। সয়াবিনের গাছ হলদেটে রঙ ধারণ করেছে। বোরো ধানের পাতা শুকিয়ে যাচ্ছে। মিষ্টি আলু পচে গেছে। কুমড়াপাতা হলুদ হয়ে আগা মরছে। লোকজন ফসল তুলে গরুকে খাওয়াচ্ছেন। অনেকে খেতেই গরু ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকে ধান খেতে জমা লোনাপানি সেচে বের করে দিচ্ছেন।

ভেলুমিয়ার চরগাজির বাসিন্দা আইয়ুব আলী (৬৫)। তিনি চর হোসেনে দেড় কানি (২ একর ৪০ শতাংশ) জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন। খরচ করেছেন ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। ৬৪ শতাংশের খেত থেকে একবার ৫০ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করেছেন। বাকি পৌনে দুই একর জমির তরমুজের দর উঠেছিল ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। তিনি আশা করেছিলেন, আরেকটু দাম উঠলে বিক্রি করবেন। কিন্তু জোয়ারে খেত ডুবে যায়। প্রায় হাঁটুসমান পানি জমে। পানিতে ঢেউও ছিল প্রচণ্ড। ভাটার সময় দেখেন অনেক ফল নেই। দিন যত যাচ্ছে, গাছের অস্তিত্ব বিলীন হচ্ছে। আইয়ুব আলীর লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি হয়েছে।

আইয়ুব আলীর মতো চর হোসেনের অসংখ্য তরমুজচাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

দৌলতখান উপজেলার মদনপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য ফারুক দৌলত বলেন, ইউনিয়নের ৮০ শতাংশ সয়াবিনের খেত আগাম জোয়ার–বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। লোনাপানিতে গাছ হলুদ হয়ে যাচ্ছে।

তবে ভোলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবু মো. এনায়েত উল্লাহ বলেন, জোয়ারের পানিতে লবণ থাকায় ফসলের ক্ষতি হয়েছে। তবে তরমুজ-বাঙ্গির খেতের ৯০ শতাংশ ফল বিক্রি শেষ। সবজিচাষিদের খেতের মেয়াদ শেষ পর্যায়ে। মুগ ও সয়াবিনে ১০ শতাংশ ক্ষতি হতে পারে।