‘জোয়ারের পানিতে মোগো বাড়িঘর সব তলাইয়্যা গ্যাছে’

বাঁধ উপচে পানি ঢুকে পড়েছে লোকালয়ে। বরগুনা সদরের ফুলতলা এলাকায়
প্রথম আলো

বরগুনার তালতলী উপজেলার জয়ালভাঙা গ্রামের নুরুল ইসলাম (৫০) আজ মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বলছিলেন, ‘জোয়ারের পানিতে মোগো বাড়িঘর সব তলাইয়্যা গ্যাছে। ধোমহা বাতাস। দেহি তো বইন্নার আলামত। কিন্তু হুনি বোলে এহোনো সিঙ্গাল ২ নাম্বার। এইডা ক্যামনে কী অয়?’

নুরুল ইসলামের মতো একই প্রশ্ন বঙ্গোপসাগর তীরের এই এলাকার বাসিন্দা আলম মিয়া, ইলিয়াস হোসেন, আলো ফকিরসহ অনেকের। তাঁদের সবার বাড়িঘরে জোয়ারের পানি ঢুকে পড়েছে। পরিবার নিয়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন।

আবহাওয়া বিভাগ বলছে, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস এখন প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে। ক্রমে ঘূর্ণিঝড়টি স্থলের দিকে এগোচ্ছে এবং যত এগোচ্ছে, ততই এর শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইয়াস এমন একটি ঘূর্ণিঝড়, যা খুব অল্প সময়ে কয়েকটি স্তর অতিক্রম করে রূপ বদলে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে। কারণ, ২১ মে এটি ছিল লঘুচাপ, ২২ মে সেটি সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়, ২৩ মে এটি নিম্নচাপ এবং ওই রাতেই তা গভীর নিম্নচাপে রূপ নেয়। ২৪ মে সকালে সেটি পরিণত হয় ঘূর্ণিঝড়ে। তখন বলা হচ্ছিল, এটি একটি ছোট ঘূর্ণিঝড়। কিন্তু আবহাওয়াবিদদের সেই ধারণা পাল্টে ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ঘূর্ণিঝড়টি আজ মঙ্গলবার সকালে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়। এখনো শক্তি বৃদ্ধি করে চলেছে ঝড়টি। শক্তি বৃদ্ধির যে প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে, তাতে এটি অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়ে স্থলে আঘাত হানতে পারে। আগামীকাল বুধবার দুপুর অথবা এর পরে এটি আঘাত হানতে পারে মনে করছেন আবহাওয়াবিদেরা। তবে এখনো ২ নম্বর হুঁশিয়ারি সংকেতই বলবৎ রাখা হয়েছে।

বরিশালের ঝুঁকিপ্রবণ এলাকার লোকজন বলছেন, ঘূর্ণিঝড়কে কেন্দ্র করে যে আলামত শুরু হয়েছে, তাতে সংকেত না বাড়ার কারণ বুঝতে পারছেন না তাঁরা। সাধারণত ঘূর্ণিঝড়টির এখন যে শক্তি এবং দেশের স্থলভাগ থেকে যে দূরত্বে রয়েছে, তাতে এর সংকেত ৪ নম্বরে উঠে যাওয়ার কথা। কিন্তু এখনো ২ নম্বর হুঁশিয়ারি সংকেতই বহাল রাখা হয়েছে। কিন্তু কেন সংকেত বাড়ছে না—এমন প্রশ্ন রাখছেন অনেকে।

বিশেষ করে আজ সকাল থেকে বরিশালের সাগরতীরবর্তী জেলাগুলোর নদ-নদীতে অধিক উচ্চতার জোয়ার, মেঘলা আর দমকা ঝোড়ো হাওয়ার দাপট ঘূর্ণিঝড়েরই আলামত বলে মনে করছেন উপকূলের বাসিন্দারা।

আবহাওয়া বিভাগ বলছে, স্যাটেলাইটের প্রাপ্ত চিত্র থেকে যা পাওয়া যাচ্ছে, তাতে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের গতিমুখ এখনো পশ্চিমবঙ্গ এবং ওডিশার দিকেই রয়েছে। ফলে, এর ঝাপটা তেমন একটা টের পাবে না দেশের উপকূলের মানুষ। আর এ জন্যই বাড়ছে না সংকেত।

বরিশাল আবহাওয়া কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক মো. আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলে, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের গতিপথ বাংলাদেশমুখী নয়। ফলে, গতিপথ পরিবর্তন না হলে এটা বাংলাদেশের স্থলভাগে আঘাত হানছে না, এটা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত। ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র, শক্তি, গতিপথ অনুসরণ করে সতর্কসংকেত দেয় আবহাওয়া অধিদপ্তর। যেহেতু ইয়াসের গতিপথ বাংলাদেশমুখী নয়, তাই ২ নম্বর সংকেত বলবৎ রাখা হয়েছে।

আবহাওয়া বিভাগ জানায়, আজ সকাল ছয়টায় ইয়াস তার শক্তি বৃদ্ধি করে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। সকালে এটি চট্টগ্রাম থেকে ৫৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার থেকে ৫২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা থেকে ৪৯০ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পায়রা বন্দর থেকে ৪৪৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বার্তা অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় পশ্চিমবঙ্গ ও ওডিশার দিকে আঘাত হানার কথা বলা হলেও এর আঁচ লাগতে পারে দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোয়। বিশেষ করে বরিশালের বরগুনা, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী এবং খুলনা বিভাগের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট—এসব জেলায়।

বড় ভয় জলোচ্ছ্বাসে

বরিশালসহ দক্ষিণ উপকূলের নদ-নদীগুলোয় জোয়ারের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে কয়েক বছর ধরেই। ফলে, বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ, নিম্নচাপ, কিংবা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হলে ১০ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে বিপন্ন হচ্ছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা।

ইয়াসের প্রভাবে বরিশালের সর্বত্র দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বিরাজ করছে। নদ-নদীতে জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। সকাল থেকেই মেঘলা আবহাওয়ার সঙ্গে যোগ হয়েছে থেমে থেমে প্রবল ঝোড়ো হাওয়া।

তবে আবহাওয়ার বার্তায় কোনো ধরনের জলোচ্ছ্বাসের আভাস দেওয়া হয়নি। তবে এরই মধ্যে বরিশালের কীর্তনখোলা, বিষখালী, বলেশ্বর, পায়রা, লোহালিয়া, তেঁতুলিয়া, মেঘনা, ইলিশাসহ সব কটি নদ-নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে জোয়ারের পানি অনেক বেড়েছে।

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের এর প্রভাবে বরিশালে সকাল থেকে আকাশে মেঘের আনাগোনা বাড়তে শুরু করেছে। সঙ্গে বইছে দমকা বাতাস। এই বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেও ঝুঁকি নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যাচ্ছে স্পিডবোট গুলো। বরিশাল নগরের ডিসি ঘাটে
সাইয়ান

উপকূলের বিভিন্ন এলাকার ভুক্তভোগী কয়েকজন বলেন, সর্বশেষ গত বছরের ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে বরিশালসহ দক্ষিণ উপকূলের নদ-নদীতে ৯ থেকে ১২ মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে উপকূলের সুরক্ষা বাঁধ উপচে পানি ঢুকে পরে লোকালয়ে। ফলে, বিভাগের ৭৬৪টি গ্রাম প্লাবিত হয়। ক্ষতির শিকার হয় প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ লোক।

আম্পানের পর এক সপ্তাহ ধরে দুই থেকে চার মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়েছে বরিশালসহ দক্ষিণ উপকূলে। এতে উপকূলের অনেক গ্রামের বাসিন্দাদের ঘরদোর দিনে ও রাতে দুবারের জোয়ারে ভেসেছে। এমনকি বরিশাল নগরের গুরুত্বপূর্ণ অনেক এলাকা হাঁটুপানিতে প্লাবিত হয়। আম্পানের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে প্রাথমিক হিসাবে বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় ১৯ হাজার ২৪টি মাছের খামার, ঘের ও পুকুরের মাছ ভেসে যায়। ফসলসহ অন্যান্য অবকাঠামো ক্ষয়ক্ষতি হয়।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের বরিশাল আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম সরকার সকালে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমদের বিভাগে ১০৪ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এর মধ্যে ৮১ কিলোমিটারের কাজ চলমান। এই কাজের ৬০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। তারপরও জলোচ্ছ্বাসে কোনো সমস্যা হলে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে যাতে ব্যবস্থা নিতে পারি, সে লক্ষ্যে আমাদের প্রস্তুতি আছে। আশা করি, সমস্যা হবে না।’