ঝুঁকি বাড়াচ্ছে কীটনাশক

সবজিতে কীটনাশক ছিটানোর পাঁচ থেকে ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত বিষক্রিয়া থাকতে পারে। কৃষকেরা খেত থেকে সে সবজি তুলে বিক্রি করছেন।

বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার চকচুপিনগর উত্তরপাড়া গ্রামের মাঠে এক কৃষক সবজিখেতে কীটনাশক ছিটাচ্ছেনছবি : প্রথম আলো

চৈত্রের দাবদাহ আর ভ্যাপসা গরম। গরমে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সবজির খেত। খেত বাঁচাতে বগুড়ার সদর ও গাবতলী উপজেলার চাষিরা সবজি খেতে অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করছেন। আর কীটনাশক ছিটানোর এক-দুই দিনের মাথায় কৃষকেরা খেত থেকে সবজি তুলে বিক্রি করছেন। কৃষি কর্মকর্তা ও চিকিৎসকেরা বলছেন, কীটনাশক ছিটানোর পরপরই খেত থেকে সবজি তুলে বিক্রি করা ঠিক না। তা খেয়ে কিডনি ও যকৃতের
জটিলতা ছাড়াও নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

কৃষি বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) একটি গবেষণাতে বগুড়ায় উৎপাদিত বেগুনসহ কিছু টাটকা সবজিতে অতিমাত্রায় কীটনাশকের উপস্থিতি মিলেছে। বারির কীটতত্ত্ব বিভাগের কীটনাশক গবেষণা ও পরিবেশ বিষতত্ত্ব শাখার ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন প্রধানের নেতৃত্বে এ গবেষণা করা হয়। গবেষণার ফল গত বছর আন্তর্জাতিক এক বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশ করা হয়। গবেষণায় সবজি ও ফলের নমুনায় সাইপারমেথ্রিন, ক্লোরোপাইরিফস, ডাইমেথয়েট, অ্যাসিফেট ও কুইনালফসের মতো ক্ষতিকর রাসায়নিক পেয়েছেন গবেষকেরা।

সদর ও গাবতলী উপজেলার বেশ কয়েকটি এলাকার চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দিনের বেলা তীব্র রোদ। বেগুন, করলা, টমেটো, শসা, মরিচের মতো সবজির ওপর এই গরমের প্রভাব পড়ছে মারাত্মক। একধরনের পোকা পাতার রস শুষে নেওয়ায় পাতা কুঁকড়ে গাছ মরে যাচ্ছে। আবার বেগুনে নলি পোকা ছিদ্র করে ঢুকে পড়ছে। এসব রোগবালাই দমনে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে খেতে কীটনাশকের ব্যবহার। সবচেয়ে বেশি কীটনাশক ব্যবহার করা হয় বেগুনে। এ ছাড়া শসা, করলা, কাঁচা মরিচ, টমেটো, ফুলকপি ও বাঁধাকপিতেও নানা মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে।

গাবতলীর আকন্দপাড়ার শসাচাষি আবদুল মজিদ বলেন, ‘ফসল বাঁচাতে খ্যাতত বিষ ছিটাচ্চি। সেই বিষমাখা ফলস মুখে দেই ক্যামনে? লিজে আবাদ করি, কিন্তু খ্যাতের বিষমাখা সবজি লিজেরা খাই না।’

কৃষকেরা আরও বলেন, খেত থেকে ফসল তুলে বিক্রি করা পর্যন্ত ফসল যাতে দেখতে তাজা ও ভালো দেখায়, সে জন্য তাঁরা শেষ সময়ে এসে কীটনাশক স্প্রে করেন। ফলে আড়তদারেরা বিক্রি করা পর্যন্ত ফসল ভালো থাকে। নূরুইল গ্রামের কৃষক মজিবর রহমান বলেন, ‘খ্যাতত পোকামাকড় মারার বিষ ব্যবহার করায় আর আগের মতো ফসল ফলিচ্চে না। ফলন কম হচ্চে। চাষবাস করে লোকসান হচ্চে। খ্যাতত বিষ দেওয়ার দুই তিন দিন পর সবজি তুলে হাটত লিচ্চি।’

তবে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা ও চিকিৎসকেরা বলেন, বেগুন, শসার মতো সবজিতে কীটনাশক ছিটানোর পাঁচ থেকে ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত বিষক্রিয়া থাকতে পারে। কীটনাশক ছিটানোর পরপরই খেত থেকে সবজি তুলে বিক্রি করলে তা খেয়ে কিডনি ও যকৃতের জটিলতা ছাড়া নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়তে পারে। এসব কীটনাশক রক্তের সঙ্গে মিশে কিডনিতে জমা হয়। দীর্ঘ মেয়াদে এসব অঙ্গ বিকল পর্যন্ত হতে পারে।

বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নেফ্রলোজি বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক আ ন ম এহসানুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, অতিমাত্রায় কীটনাশক মেশানো সবজি খেলে কিডনির নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বগুড়ার উপপরিচালক দুলাল হোসেন বলেন, বগুড়ার কৃষকেরা সবজি খেতে অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করেন। ফসলে বিষাক্ত রাসায়নিক কীটনাশকের বিকল্প হিসেবে জৈব কীটনাশক এবং কীটপতঙ্গ দমনের প্রাকৃতিক পদ্ধতি ব্যবহার নিশ্চিত করতে কৃষকদের নানাভাবে সচেতন করা হচ্ছে। এ ছাড়া ফসলে অতিমাত্রার কীটনাশক ও রাসায়নিকের ব্যবহার হ্রাস করতে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারাও কৃষক পর্যায়ে কাজ করছেন। আশা করা যায়, ক্ষতিকর বিষাক্ত রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার দিনে দিনে কমে আসবে।