টানা চারবার অপরাজিত একজন শাহানারা

রাজশাহীর বাগমারার ভবানীগঞ্জ পৌরসভার প্রতিষ্ঠাকাল থেকে সংরক্ষিত-২ (৪, ৫ ও ৬) ওয়ার্ডের টানা চারবার কাউন্সিলর পদে জয়ী শাহানারা খাতুন (ডানে)সংগৃহীত

রাজশাহীর বাগমারার ভবানীগঞ্জ পৌরসভার সংরক্ষিত-২ (৪, ৫ ও ৬) ওয়ার্ডে এবার নিয়ে টানা চারবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন শাহানারা খাতুন। তাঁর সাফল্যের পেছনে রসায়ন জনপ্রতিনিধি কেমন হতে হবে, তারই যেন একটি আদর্শ উদাহরণ। শাহানারা তাঁর এলাকার মানুষের কাছে তুমুল জনপ্রিয় একজন জনপ্রতিনিধি। ভোটের মাঠের প্রতিদ্বন্দ্বীরাও তাঁর প্রশংসা না করে পারেন না।

ভবানীগঞ্জ পৌরসভা প্রতিষ্ঠার পর গত ২০০২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনেই প্রথম কাউন্সিলর নির্বাচিত হন শাহানারা। প্রথম নির্বাচনে সংরক্ষিত-২ (৪, ৫ ও ৬) ওয়ার্ডে শাহানার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তাঁরই একজন প্রতিবেশীসহ তিনজন প্রার্থী। প্রথম নির্বাচিত হওয়ার পর আর পরাজিত হতে হয়নি তাঁকে। নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য তিনি মাঠে থেকেছেন, যার ফলাফল পরের তিন দফা নির্বাচনেও তিনি বিজয়ী হয়েছেন। ২০১৫ সালের নির্বাচনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন উপজেলা পরিষদের বর্তমান মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মমতাজ আক্তারসহ তিনজন প্রার্থী। সেবার বিপুল ভোটে বিজয়ী হন শাহানারা। মমতাজ আক্তার পরবর্তী সময়ে ২০১৯ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে জয়ী হন।

ভবানীগঞ্জ পৌরসভার সংরক্ষিত-২ (৪, ৫ ও ৬) ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শাহানারা খাতুন
ফাইল ছবি

সর্বশেষ এবার দ্বিতীয় দফা পৌরসভা নির্বাচনে ১৬ জানুয়ারি কাউন্সিলর পদে জয়ী হয়েছেন শাহানারা। এবারও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তিনজন প্রার্থী। এবার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে ৫১২ ভোট বেশি পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন শাহানারা। এভাবেই একে একে টানা চারবার পৌরসভা নির্বাচনে একই সংরক্ষিত ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে অপরাজিত থেকেছেন তিনি।

শাহানারা খাতুন একজন গৃহবধূ। তিনি ভবানীগঞ্জের খুচরা সার ব্যবসায়ী আক্কেল আলীর স্ত্রী। আক্কেল আলী বলেন, তাঁদের দুই ছেলেমেয়েদের মধ্যে মেয়ের বিয়ে হয়েছে। আর ছেলে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছে। সামান্য ব্যবসা করে তাঁদের সংসার চলে। সংসারের কোনো চাপ না থাকার কারণে তাঁর স্ত্রী এলাকার লোকজনের পাশে থাকেন।
নিজ এলাকার জনপ্রতিনিধি হিসেবে শাহানারার জনপ্রিয়তা ও অপরাজিত থাকার রহস্য জানতে ভোটের পর ১৭ ও ১৮ জানুয়ারি দুই দিন সরেজমিনে কথা হয় তাঁর পরিবার ও এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে।

নির্বাচনের সময় রাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচারণা চালান শাহানারা
সংগৃহীত

স্থানীয় অর্ধশত নারী ও পুরুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শাহানারা প্রতিদিন সকালের রুটিন বাড়ির কাজ সেরেই এলাকায় বেরিয়ে পড়া। এলাকার বাসিন্দাদের বাড়িতে গিয়ে এ সময় কুশল বিনিময় করা ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের খোঁজখবর নেন তিনি। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে এভাবেই নিজের দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি। শাহানারার সফলতার পেছনে লোকজনের সঙ্গে তাঁর অমায়িক ব্যবহার একটি বড় অনুঘটকের কাজ করেছে। নিজ প্রচেষ্টায় তিনি দেড় যুগ ধরে যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছেন। শাহানারা খাতুন প্রতিনিয়ত এলাকার লোকজনের বাড়িতে গিয়ে তাঁদের খোঁজখবর নেওয়ার পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন সুযোগ–সুবিধার কথা তাঁদের জানান। এলাকাবাসীর পরিবারের অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের গল্প জেনে গোপনে এসব লোকজনের তালিকা তৈরি করেন। তারপর মেয়রের সঙ্গে আলাপ করে তাঁদের সুবিধাভোগীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেন। এভাবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রকৃত অসহায় লোকজনকে সুবিধা পেতে সহায়তা করেন। এমনকি সুবিধাভোগীদের জন্য বিভিন্ন অফিস ও ব্যাংকে দৌড়ঝাঁপ তিনিই করেন। এরই প্রতিদান পাচ্ছেন তিনি প্রতিবার ভোটে।

শাহানারার সফলতার পেছনে লোকজনের সঙ্গে তাঁর অমায়িক ব্যবহার একটি বড় অনুঘটকের কাজ করেছে। তিনি প্রতিনিয়ত এলাকার লোকজনের বাড়িতে গিয়ে তাঁদের খোঁজখবর নেওয়ার পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন সুযোগ–সুবিধার কথা তাঁদের জানান। এমনকি সুবিধাভোগীদের জন্য বিভিন্ন অফিস ও ব্যাংকে দৌড়ঝাঁপ তিনিই করেন।

ভবানীগঞ্জ মাস্টারপাড়া এলাকার বাসিন্দা বিশ্বজিৎ সরকার বলেন, শাহানারা খাতুন নিয়মিতভাবে তাঁর এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে ছুটে যান। লোকজনের সঙ্গে মিশে সহজে আপন হতে পারেন। এটাই তাঁর বড় গুণ।

এলাকার বাসিন্দা কলেজশিক্ষক কামাল হোসেন বলেন, শাহানারা খাতুনের আচরণ ও সব সময় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর গুণেই লোকজন তাঁকে বারবার নির্বাচিত করছেন। তিনি শুধু নির্বাচনের সময় নয়, সারা বছরই লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন এবং তাঁদের কাছাকাছি থাকেন। এসব কারণে তিনি ভোটারদের দৃষ্টিতে সর্বদা একজন যোগ্য প্রার্থী।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শাহানারার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সাবেক একজন প্রার্থী বলেন, শাহানারা আপা একজন ভালো মানুষ। তাঁর কাছ থেকে অনেক শেখার আছে। তিনি সহজে মানুষের সঙ্গে মিশে আপন হতে পারেন। তাঁর সততা ও এই গুণের কারণে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

লোকজনের ভালোবাসার কারণে টানা ১৮ বছর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। সব সময় মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং মিলেমিশে থাকাকেই বড় সম্বল বলে মনে করি।
শাহানারা খাতুন

পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী লিটন মিঞা প্রথম আলোকে বলেন, ১৮ বছর ধরে শাহানারার সঙ্গে একজন সহকর্মী হিসেবে কাজ করছেন। তাঁর ব্যবহার আর নমনীয়তা মুগ্ধ করে। তিনি শুধু এলাকার ভোটারদের কাছে নন, পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছেও একজন যোগ্য কাউন্সিলর।

শাহানারা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, লোকজনের ভালোবাসার কারণে টানা ১৮ বছর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। নিজেকে তিনি কাউন্সিলর মনে করেন না, একজন সেবক হিসেবেই তাঁদের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। সব সময় মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং মিলেমিশে থাকাকেই বড় সম্বল বলে মনে করেন তিনি। যত দিন সুস্থ থাকবেন লোকজনের সেবা করতে চান বলে জানান শাহানারা; তবে নারী কাউন্সিলরদের ক্ষমতা বাড়ানো এবং বিভিন্ন সরকারি কাজে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন শাহানারা।