‘টিভিতে তো দেখি সরকার কম দেয় না, সেসব কার্ড পায় কারা?’

ওএমএসের চাল সংগ্রহের জন্য নারীদের অপেক্ষা। খুলনা শহরের পশ্চিম টুটপাড়া মওলার বাড়ি মোড় এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

স্বামী আর একমাত্র সন্তান নিয়ে সালমা বেগমের (৪০) সংসার। ভ্যানে করে মনিহারি পণ্য ফেরি করতেন স্বামী। সংসার তাতে ভালোই চলছিল। তবে করোনার সময় বসে থাকায় ব্যাটারিচালিত সেই ভ্যান নষ্ট হয়ে গেছে। হেঁটে হেঁটে ব্যবসাটা কোনোমতে চালু রাখলেও সংসারে আর্থিক টানাপোড়েন দিন দিন বেড়েই চলেছে। আগে বাইরে বের হওয়া না লাগলেও এখন নিয়মিত ন্যায্যমূল্যের খোলাবাজার (ওএমএস) থেকে চাল সংগ্রহের জন্য সালমাকে বের হতে হচ্ছে।

সালমা বেগম থাকেন খুলনা নগরের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের জিন্নাহপাড়া কমিশনার কালভার্ট এলাকায়। আজ বুধবার সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে পশ্চিম টুটপাড়া মওলার বাড়ি মোড় এলাকায় ওএমএসের চাল সংগ্রহের জন্য অপেক্ষা করছিলেন সালমা বেগম। দোকান খুলতে তখন ঘণ্টা তিনেক বাকি থাকলেও লম্বা লাইনের ধকল এড়াতে আগেভাগে এসেছেন তিনি। দোকানের সামনে ব্যাগের ওপর ইটচাপা দিয়ে রেখে কয়েক গজ দূরের নূর মসজিদ রোডের মোড়ে বসেছিলেন। ঈদের পর বিভিন্ন ওএমএস পয়েন্ট থেকে তিনবার চাল কিনতে পেরেছেন তিনি।

সেখানেই কথা হয় সালমা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রোজগার করোনার পরে বইসে গেছে। আগে স্বামীর ব্যাটারি ভ্যান ছিল, তাতে ঘুরে ঘুরে ফেরি করতেন। করোনার সময় ভ্যানের ব্যাটারি নষ্ট হওয়ায় এখন হেঁটে হেঁটে ব্যবসা করেন। বাধ্য হয়ে এই রাস্তায় এসে বসে থাকতে হচ্ছে। আশপাশে যেদিন যেখানে চাল দেয়, সেখানেই যাই। ঘরে চাল থাকলে কয়ডা চাল ফুটিয়ে একটা পেঁয়াজ আর মরিচ ডলা দিয়ে তা–ও খাওয়া যাবে।’ তিনি বলেন, ‘কোনো সময় দুই কেজি, কোনো দিন তিন কেজি; আবার মাঝে মাঝে পাঁচ কেজি চালও পাই। আসি ভোরে। দেরি করলে লাইনে ঠ্যালাঠালি, ধাক্কাধাক্কি করে পারি না। চাল নিয়ে বাসায় ফিরতে কখনো ১১টা, কখনো ১২টা পার হয়ে যায়।’

চাল দেওয়া নিয়ে বিস্তর অভিযোগ সালমা বেগমের। ক্ষোভ আর হতাশা নিয়ে বললেন, দোকানের লাল কাপড়ে চাল ও আটা যে পরিমাণ দেওয়া হবে বলে লেখা থাকে, তা দেয় না। যা পাওয়া যায়, তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কাউরে বলা যায় না। বললে শত্রু হতে হবে। একটু দম নিয়ে সালমা বেগম ফের বলেন, ‘সরকার তো কম দিচ্ছে না। তবে যাঁদের দায়িত্ব দেয়, তাঁরা তো ঠিকমতো কাজ করে না। করোনার সময় থেকে এত জিনিস আসছে, কিছু পাইনি। মুখ চিনে চিনে দেয়। ভোটের সময় যাঁরা কাউন্সিলর বা নেতাদের কাজ করেন, কাছের লোক থাকেন; তাঁরাই পান। কাউন্সিলরের বাড়ির দিকে কম করে হলেও এক শ দিন হাঁটিছি। কিন্তু কিছু পাইনি। যারা পাওয়ার উপযুক্ত না, তারা কিন্তু ঠিকই পাচ্ছে।’

সালমা বেগমের পাশে বসেছিলেন আমেনা বেগম (৬০)। আমেনারা থাকেন টুটপাড়া তালতলা হাসপাতাল এলাকায়। আমেনার চার মেয়ে আর দুই ছেলে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেরা আলাদা সংসার পেতেছে। স্বামী, স্ত্রী, বিধবা এক মেয়ে আর সেই মেয়ের সন্তানকে নিয়ে এখন আমেনার সংসার। তিনিও সকাল ছয়টা থেকে অপেক্ষা করছেন চাল নেওয়ার জন্য।

আমেনা বলেন, স্বামীর অনেক বয়স হয়েছে। ঠিকমতো চলতে পারেন না। রূপসায় ছোট একটা নার্সারির ব্যবসা করেন। তাতে যা আয় হয়, তার প্রায় পুরোটাই ওষুধের পেছনে ব্যয় হয়। তিনি সংসারের কাজ সামলান। ওএমএস থেকে চাল কেনাটা এখন একটা বড় কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁর।

আমেনার ভাষ্য, ‘তেল, চাল, ডাল, আটা–ময়দা আমাদের মতো মানুষরা আর দোকান থেকে কিনতে পারছে না। চাল বাইরে কম করে ৫০ টাকা কেজি। কম দামে মাসের কয়েকটা দিনের চাল কিনে রাখতে পারলে কিছুটা টেনশনমুক্ত থাকা যায়। এখানে আজ দিছে আবার এক সপ্তাহ পরে দেবে। কাছাকাছি যেসব স্পট আছে, সেখানে যাই।’

চালের কথা বলতে বলতে অন্য জিনিসপত্রের প্রসঙ্গ তুলে আমেনা বলেন, ‘কোনো জায়গায় কাজ করার তাগোদও নাই। আয়ও নাই। অনেক দিন পর গতকাল একটু মাছ খাইলাম। একটা তেলাপিয়া মাছ ঢ্যাঁড়স দিয়ে রান্না করছিলাম। তার আগের দিন শাক ভাজা খাইছি। আজ কি রান্না হবে জানি না। জান তো ওপর ওয়ালা একপালি না একপালি রাখবে। আমাগো মতো মানুষ এখন মাংস কিনে খাতি পারে না।’

পাশ থেকে শাফিয়া বেগম বলে ওঠেন, ‘ধরতে গেলি মাছ খাইনে। পনেরো দিন পর যদি এক দিন হয়, তা আবার বড় মাছটাছ না। ওই কম দামের সাগরের ভোলা, বউ মাছ, কঙ্কণ মাছ এসব। ডাল প্রতিদিন চলে। ৪ কেজি আলু ১০০ টাকা দিয়ে কিনে ১০-১২ দিন খাই। মাছ, মাংস খাওয়ার আশা কইরেও লাভ নাই, বইলেও লাভ নাই। আমাগো নসিবে এখন ওসব নাই।’

সালমা, আমেনাদের মতো শাফিয়া বেগমও চাল কিনতে সাতসকালে হাজির হয়েছেন। শাফিয়া বেগমের সংসারেও চারজন মানুষ। ১৬ বছর ধরে বিছানায় পড়ে আছেন স্বামী। সংসারে রোজগারের কোনো লোক নেই। তালতলা হাসপাতাল এলাকায় দুটি টিনের ছাপরা ভাড়া দিয়ে মাসে হাজার চারেক টাকার মতো আসে, তা দিয়েই সংসার চালিয়ে নিতে হচ্ছে তাঁদের।

শাফিয়া বলেন, ‘সংসার চলে না। কোনো রকমে চালাতি হয়। চালডা ম্যানেজ হলি তা–ও কিছুটা চলে। এ জন্য অনেক সকালে আসি। তা–ও এখন একটু দেরি করে আসলেও চলে। আগে রাত তিনটেয়-চারটেয় আসতে হতো। করোনার সময় অনেক মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুপুরে আজান দেওয়ার পরে খালি হাতে ফিরে যেত। এখন লাইনে দাঁড়িয়ে কমবেশি পাওয়া যায়। ঈদের পর অনেকে এখনো শহরে না ফেরায় ভিড় একটু কম।’

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সালমা, শাফিয়াদের দলে লোক বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে অপেক্ষা। আজ কতটুকু চাল পেতে পারেন, তা নিয়ে চলতে থাকে জল্পনা। অপেক্ষমাণ নারীদের একজন বলে ওঠেন, ‘টিভিতে তো দেখি সরকার কম দেয় না। সেসব কার্ড পায় কারা? আমাদের চোখের সামনে দেখছি যাদের বাড়ি আছে, বড় লোক, গলার জোর আছে; তারাই পায়।’