ঠিকমতো চুলা জ্বলে না, নেই জীবিকার দিশা

কক্সবাজার পৌরসভার নাজিরারটেক উপকূলের শুঁটকিমহালে কাজ করছেন নারী শ্রমিকেরা। ছবি: প্রথম আলো
কক্সবাজার পৌরসভার নাজিরারটেক উপকূলের শুঁটকিমহালে কাজ করছেন নারী শ্রমিকেরা। ছবি: প্রথম আলো
>দেশের সর্বদক্ষিণের জেলা কক্সবাজার পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের জন্য বিখ্যাত। ২ হাজার ৪৯১ দশমিক ৮৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই জেলায় উপজেলা রয়েছে ৮টি, ইউনিয়ন ৭১টি ও গ্রাম ৯৯২টি। কৃষি, মৎস্য, শুঁটকি, চিংড়ি, কাঁকড়া, লবণ, পর্যটন ও শ্রমনির্ভর অর্থনীতির এই জেলায় লোকসংখ্যা ২৬ লাখের কাছাকাছি। এর মধ্যে মাছ আহরণ, শুঁটকি আর লবণ উৎপাদন, বিপণনেই জড়িত ১৫ লাখ মানুষ। এর মধ্যে লাখের কাছাকাছি লোক জলবায়ু উদ্বাস্তু। করোনাকালে পেশা হারিয়ে দিশেহারা তাঁরাসহ লাখো শ্রমজীবী মানুষ। করোনাকালে এই জনপদজুড়ে উদ্বাস্তু, খেটে খাওয়া শ্রমজীবী জেলে, শুঁটকিশ্রমিক ও লবণচাষিদের কষ্টের গল্পগুলো ভিন্ন রকম হলেও জীবনযাপনে একটি বিষয় অভিন্ন। আর তা হলো ভীষণ মানবেতর আর দুর্বিষহ অবস্থার মধ্য দিয়ে সময় কাটছে তাঁদের। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে উঠে এসেছে তাঁদের কষ্টের চিত্র।

প্রচণ্ড রোদ উপেক্ষা করে বাঁকখালী নদীর উপকূলীয় প্যারাবন থেকে চিংড়ি মাছের পোনা ধরে বাড়ি ফিরছিলেন রাবেয়া বেগম (৩৫)। সঙ্গে তাঁর ১১ বছর বয়সী ছেলে সোহেল। মাছের পোনা বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যাবে, তা দিয়েই চলবে তাঁর পাঁচ সদস্যের সংসার। ৩০ জুন বেলা সোয়া একটার দিকে সেখানে তাঁর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। দ্বিতীয় দফায় তাঁর সঙ্গে কথা হয় ৫ জুলাই দুপুরে। তখনো তিনি মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করছিলেন। পেশায় তিনি শুঁটকিশ্রমিক।

হাঁটতে হাঁটতে কথা হচ্ছিল রাবেয়ার সঙ্গে। রাবেয়ার যে গ্রাম, তার নাম কম্বলপাড়া। কক্সবাজার পৌরসভার সবচেয়ে দুর্গম এই গ্রামের অবস্থান উত্তর নুনিয়াছটার একেবারে শেষ প্রান্তে। গ্রামের ৯৯ শতাংশ মানুষ শ্রমজীবী জলবায়ু উদ্বাস্তু। এক দশক আগে জেলার কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া, চকরিয়াসহ বিভিন্ন উপকূলে বসতভিটা হারিয়ে ভাসমান মানুষগুলো মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছে গ্রামটিতে। গ্রামটির উত্তর পাশে বাঁকখালী নদী এবং নদীর তীরে সৃজিত ঘন সবুজ প্যারাবন। এরপর মহেশখালী চ্যানেল, তারপর বঙ্গোপসাগর। এই ঝড়, এই বৃষ্টি, এই প্রখর রোদের খেলায় কাটছে অভাবী মানুষগুলোর করোনাকাল।

রাবেয়ার বাড়ি মহেশখালীর ধলঘাটা উপকূল। ৯ বছর আগে এ উপকূলে মাথা গোঁজার ঠাঁই করেন। এক বছরের মাথায় তাঁর স্বামী বঙ্গোপসাগরে ট্রলারডুবিতে নিখোঁজ হন। এ পর্যন্ত খোঁজ নেই তাঁর। এরপর সংসারে হাল ধরেন তিনি। সংসারে তাঁর চার ছেলে। রাবেয়া বললেন, এলাকার শুঁটকি উৎপাদনের মহালে (কারখানায়) শ্রমিকের কাজ করতেন তিনি। করোনাভাইরাসের কারণে গত ২০ মার্চ থেকে সব কটি মহাল বন্ধ। এখন প্যারাবন থেকে মাছ ও পোনা ধরেই চলছে তাঁর টানাপোড়েনের সংসার।

আক্ষেপের সুরে রাবেয়ার জিজ্ঞাসা, ‘বদ্দা, আঁরা হঅত্যে হাজ পাইয়্যূম? হাজ গরিত নঅপাইল্যে ঘরর বেয়গ্গুন নাহাই মরিয়ুম।’

হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাই গ্রামের ভেতরে। পায়ে হাঁটার রাস্তা ছাড়া গ্রামটিতে রিকশা, ইজিবাইক (টমটম), সিএনজি (অটোরিকশা) চালানোর মতো পাকা সড়ক নেই। নেই বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সাড়ে তিন মাস আগের কর্মচঞ্চল গ্রামটি এখন নীরব মৃত্যুপুরী। করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই গ্রামটিতে। নারী-পুরুষ-শিশু কারও মুখে দেখা গেল না একটি মাস্ক।

গ্রামের উত্তর পাশের বাড়িটি জেলে শফিকুর রহমানের। বাড়িতে উঠানে ৩০-৪০ জন নারীর হইচই। রাবেয়াও তাঁদের দলে যোগ দিলেন। শ্রমজীবী নারীরা আরেকজন নারীকে ঘিরে রেখেছেন, তুলে ধরছেন অভাব–অভিযোগের কথা। কাছে গিয়ে দেখা গেল, তিনি নারীনেত্রী শাহীনা আক্তার পাখি। পৌরসভার সংরক্ষিত-১ নম্বর ওয়ার্ডের (১,২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ড) কাউন্সিলর। তিনি শ্রমজীবী নারীদের ঘরে ঘরে দ্রুত চাল পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস দিলেন।

গ্রামের জেলে সৈয়দ করিম (৪৫) বলেন, ‘একসঙ্গে এ রকম দুঃসময়ের মুখোমুখি আমরা আগে হইনি। একদিকে করোনাকাল, আয়-রোজগারের সব পথ বন্ধ। অন্যদিকে চলছে বঙ্গোপসাগরে মৎস্য আহরণ বন্ধে ৬৫ দিনের সরকারি নিষেধাজ্ঞা। সব মিলিয়ে জলবায়ু উদ্বাস্তু শ্রমজীবী মানুষগুলোর কাহিল পরিস্থিতি যাচ্ছে।’

এযাবৎ পৌরসভার পক্ষ থেকে ১০ কেজি করে চাল পাওয়া গেছে। এখন অধিকাংশ পরিবার অনাহারে-অর্ধাহারে থাকছে। এক বেলা ভাত জোগাড় করতে যেখানে পরিবারগুলোর হিমশিম অবস্থা, সেখানে করোনা মোকাবিলার মাস্ক, সাবান, স্যানিটাইজার কেনার সামর্থ্য কারও নেই দাবি করেন কম্বলপাড়া সমাজ কমিটির সভাপতি নুরুল আলম। তিনি বলেন, আয়–রোজগারের কোনো দিশাই খুঁজে পাচ্ছেন না উপকূলের শ্রমজীবী মানুষগুলো।

নুনিয়াছটা, সিসিডিবি মোড়, পানিকুপ পাড়া, শিল্প এলাকা, নাজিরারটেক, কুতুবদিয়াপাড়া, সমিতিপাড়া, ফদনারডেইল, মোস্তাইক্যা পাড়া, বাসিন্যা পাড়ারও একই চিত্র। গ্রামগুলোর অবস্থান কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পশ্চিম, উত্তর ও পূর্বদিকে। সব কটি গ্রাম পড়েছে পৌরসভার ১ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডে। করোনায় এ পর্যন্ত এলাকায় মারা গেছেন মৎস্য ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীন (৪২), পৌর আওয়ামী লীগ নেতা মো. করিমসহ (৩২) পাঁচজন। এই দুই ওয়ার্ডে আক্রান্ত ১৩৮ জনের মতো। এ নিয়ে ১৯ জুলাই পর্যন্ত জেলায় মোট আক্রান্ত ৩ হাজার ১২৬ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৪৯ জন।

কাউন্সিলর শাহীনা আক্তার পাখি বললেন, পৌরসভার এই দুটি ওয়ার্ডের ১৮টি গ্রামে অন্তত ৭০ হাজার শ্রমজীবী মানুষের বসতি। এঁদের ৯০ শতাংশ জলবায়ু উদ্বাস্তু। ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে কক্সবাজারের বিভিন্ন দ্বীপ থেকে বাড়িঘর হারিয়ে এখানে বসতি গড়েছেন। এর মধ্যে নারী ২০ হাজার ও শিশু ১০ হাজার। নারী ও শিশুদের ৯০ শতাংশ উপকূলের প্রায় ৭০০ শুঁটকিমহালে শ্রমিকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। গত ২০ মার্চ থেকে মহালগুলো বন্ধ। ফলে বেকার জীবন কাটাচ্ছেন হাজার হাজার নারী-পুরুষ। অনেকে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন।

দুপুরে নুনিয়াছটা এলাকায় পাওয়া গেল ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মিজানুর রহমানকে। তিনি তখন চাল বিতরণ করছিলেন। মিজানুর রহমান বলেন, ওই দিন তিনি ৬০০ পরিবারে ১০ কেজি করে চাল দিয়েছেন। আগে দিয়েছেন আরও ৬০০ পরিবারে ১০ কেজি করে চাল। ১ নম্বর ওয়ার্ডেও ১ হাজার ৬০০ পরিবারে দেওয়া হয়েছে ১০ কেজি করে চাল। কিন্তু এ চালে দুই-তিন দিনের বেশি চলে না শ্রমজীবী মানুষের সংসার।

প্রায় ছয় হাজার ট্রলার নিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে ইলিশসহ নানা প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ আহরণ করেন জেলার অন্তত ৯৮ হাজার জেলে। আহরিত মাছের উল্লেখযোগ্য অংশ জেলার প্রায় দুই হাজার মহালে শুঁটকি করেন আরও এক লাখ শ্রমজীবী মানুষ। উপকূলের ৫৭ হাজার একর জমিতে বার্ষিক জাতীয় চাহিদার অতিরিক্ত লবণ উৎপাদন করেন ৪৪ হাজার প্রান্তিক চাষি। সব মিলিয়ে মৎস্য আহরণ, শুঁটকি ও লবণ উৎপাদন, বিপণন ও পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন ১৫ লাখের বেশি মানুষ। করোনাকালে দিশা খুঁজে পাচ্ছেন না এই মানুষগুলো।

কক্সবাজার চেম্বারের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, সাড়ে তিন মাসের করোনাকালে জেলার মৎস্য, শুঁটকি, লবণ ও পর্যটন খাতে ১০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে ক্ষতি কাটিয়ে তোলা কঠিন হবে।

কক্সবাজার পৌরসভার নাজিরারটেক উপকূলের শুঁটকিমহালে সীমিত আকারে চলছে শুঁটকি মাছের উৎপাদন। ছবি: প্রথম আলো
কক্সবাজার পৌরসভার নাজিরারটেক উপকূলের শুঁটকিমহালে সীমিত আকারে চলছে শুঁটকি মাছের উৎপাদন। ছবি: প্রথম আলো

শুঁটকিপল্লিতে বেহাল মানুষের জীবন
কম্বলপাড়ার পশ্চিম পাশে দেশের সর্ববৃহৎ ‘নাজিরারটেক শুঁটকিপল্লি’। শহরের সৈকত সড়ক হয়ে ডায়াবেটিক হাসপাতাল-এডিবি হ্যাচারি অতিক্রম করে যেতে হয় পাঁচ কিলোমিটার দূরের নাজিরারটেক উপকূল। আগের ইট ও বালুর ভাঙাচোরা রাস্তাটি এখন দুই পাশে ড্রেন দিয়ে পাকাকরণ হচ্ছে। এ কারণে যানবাহনের চলাচল বন্ধ। মোটরসাইকেলে কিছু দূর, তারপর হেঁটেই যেতে হয় নাজিরারটেক শুঁটকিপল্লি।

নাজিরারটেকে দেখা যায়, একটি মহালে রোদে শুকিয়ে শুঁটকি উৎপাদন করছেন সাতজন শ্রমিক। মাছের বেশির ভাগ ছুরি শুঁটকি। উৎপাদিত শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ২৫০-৭০০ টাকায়। মহালের মালিক জিয়াউর রহমান বলেন, গত বছর তিনি এই মহালে ৩৬ লাখ টাকার শুঁটকি উৎপাদন করেছিলেন। এবার অর্ধেকও হবে না। করোনার কারণে ইতিমধ্যে সাড়ে তিন মাস চলে গেছে। কয়েক দিন হলো, আগের হিমায়িত কিছু মাছ রোদে শুকিয়ে শুঁটকি করা হচ্ছে।

এর আশপাশের আরও ১০-১২টি মহালেও চলছে সীমিত আকারে শুঁটকির উৎপাদন। মহালগুলোতে কাজ করছেন শতাধিক শ্রমিক। বেশির ভাগই নারী-শিশু। প্রতিটি মহালে কাঁচা মাছ রোদে শুকানোর জন্য তৈরি হয়েছে বাঁশের মাচা ও বেড়া। সেখানে টাঙিয়ে রোদে শুকানো হয় মাছ। তারপর তৈরি হয় শুঁটকি।

প্রচণ্ড গরমে শুঁটকি উৎপাদনে ব্যস্ত আনসারা বেগম (৪৫)। ছয় বছর আগে তাঁর স্বামী জয়নাল সাগরে ট্রলারডুবিতে মারা গেছেন। এরপর সংসারের হাল ধরতে শুঁটকিশ্রমিকের কাজ বেছে নেন তিনি। তাঁর বাড়ি মহেশখালীতে। সংসারে পাঁচ মেয়ে, এক ছেলে। আক্ষেপের সুরে আনসারা বেগম বললেন, ‘সারা দিন পরিশ্রম করে মজুরি পাই ৩০০ টাকা, এ টাকায় সংসার চলে?’

পশ্চিম কুতুবদিয়াপাড়ার আরেকটি মহালে শুঁটকি উৎপাদন করছেন আবদুল হামিদ (৪৫)। তাঁর বাড়ি পেকুয়ায়। সংসারে স্ত্রী ও পাঁচ ছেলেমেয়ে। তাঁর অভিযোগ, আগে মহালে কাজ করে পাওয়া যেত দৈনিক ৬০০ টাকা। এখন পাচ্ছেন তার অর্ধেক ৩০০ টাকা। করোনাকাল জীবন-জীবিকা হুমকিতে ফেলে দিয়েছে।

মহালের আশপাশের গ্রামগুলোতে হাজার হাজার মানুষ বেকার। কয়েকটি ঘরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ঠিকমতো চুলা জ্বলে না। অধিকাংশ শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্যে জুটছে ভাতের সঙ্গে আলুভর্তা, ডাল আর শাকসবজি। মাছের রাজ্যে তাঁরা মাছ ও শুঁটকির নাগাল পাচ্ছেন না।

দেশি-বিদেশি হাজারো মানুষে ভরপুর থাকা একসময়ে নাজিরারটেক এখন জনশূন্য। রাস্তাঘাটের উন্নয়নে কর্মরত শতাধিক শ্রমিক ছাড়া গ্রামের মানুষের তেমন সাড়াশব্দ নেই। সড়কের দুই পাশের দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় বন্ধ। কিছু দোকান খোলা হলেও বেচাবিক্রি তেমন নেই।

সমুদ্র উপকূলের শেষ প্রান্ত নাজিরারটেক পুরানবাজার শুঁটকিমহালের কাছে একটি সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন কয়েকজন শুঁটকি ব্যবসায়ী। তাঁদের একজন মো. ফোরকান (৪২) বলেন, ১৫ বছর ধরে তিনি এলাকায় শুঁটকির ব্যবসা করছেন। কিন্তু এ রকম খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন তিনি আগে হননি। গত বছর তিনি একাই ৪০ লাখ টাকার শুঁটকি কিনে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে সরবরাহ করেছিলেন। এবার লকডাউনের কারণে মার্চ থেকে শুঁটকির উৎপাদন ও সরবরাহ দুটোই বন্ধ আছে।

নাজিরারটেক এলাকায় মো. ফোরকানের মতো ক্ষুদ্র শুঁটকি ব্যবসায়ী রয়েছেন প্রায় ৪ হাজার। প্রতি মৌসুমে তাঁরা ৫ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকার শুঁটকি সরবরাহ করেন দেশের বিভিন্ন এলাকায়। শুঁটকি ব্যবসায়ী বদিউর রহমান (৪৫) বলেন, ইতিমধ্যে তিনি ৫ লাখ টাকার শুঁটকি কিনে মজুত করেছেন। কিন্তু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সরবরাহ করতে পারছেন না।

গত ৩০ জুন থেকে জেলায় লকডাউন প্রত্যাহার করা হয়। ১ জুলাই থেকে শহরের শুঁটকির দোকানগুলো খুলতে শুরু করেছে। কিন্তু শুঁটকির তেমন মজুত নেই। দোকানগুলোতে আগের মজুতকৃত প্রতি কেজি লইট্যা শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়। ফাইস্যা ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা, ছুরি ৭০০ থেকে ৯৫০ টাকা, চিংড়ি ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা, ছোট পোপা ৪০০ থেকে ৫৫০ টাকা, রুপচাঁদা ১৫০০ থেকে ২৫০০ টাকা, লাক্ষা ১৪০০ থেকে ১৮০০ টাকা, মাইট্যা শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। অনলাইনেও দেশের বিভিন্ন স্থানে শুঁটকি সরবরাহ শুরু করেছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।

টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন, মহেশখালী, কুতুবদিয়াপাড়া, পেকুয়াতেও মৌসুমে উৎপাদিত হয় ১২০ কোটি টাকার বেশি শুঁটকি। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম খালেকুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, গত ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে ৬৫ দিনের মাছ আহরণ বন্ধ কর্মসূচি ছিল। তাই শুঁটকি উৎপাদনও বন্ধ ছিল। তিনি বলেন, গত মৌসুমে জেলায় ২০ হাজার ৬৩৭ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদিত হয়েছিল। এবার শুঁটকির উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৬ হাজার মেট্রিক টন, যার বাজারমূল্য ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা।

কক্সবাজার উপকূলে চলছে ৬৫ দিনের মাছ ধরা বন্ধ কর্মসূচি। টেকনাফ মেরিনড্রাইভ সড়কের পাশে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে রকমারি ডিঙি নৌকা। ছবি: প্রথম আলো
কক্সবাজার উপকূলে চলছে ৬৫ দিনের মাছ ধরা বন্ধ কর্মসূচি। টেকনাফ মেরিনড্রাইভ সড়কের পাশে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে রকমারি ডিঙি নৌকা। ছবি: প্রথম আলো

নিষেধাজ্ঞা-লকডাউনে দিশেহারা জেলেরা
বঙ্গোপসাগর থেকে ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছ ধরে ট্রলারগুলো ফিরে আসে কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীতে। নদীর নুনিয়াছটা ফিশারিঘাটেই বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের (বামউক বা বিএফডিসি) প্রধান পাইকারি মাছ বিক্রি বাজার। ১ জুলাই দুপুরে সেই বাজারে গিয়ে কাউকে পাওয়া গেল না। বাজারের পাশের বাঁকখালী নদীতে নোঙরে আছে কয়েক শ ট্রলার। ৭ জুলাই বিকেল পর্যন্ত সেখানকার চিত্র একই রকম দেখা যায়।

এফবি সাগর ট্রলারের জেলে মো. আলমগীর (৪৫) বলেন, করোনার আগে এই বাজারে দৈনিক কয়েক কোটি টাকার মাছ বেচাবিক্রি হতো। এখন পুরোটাই ফাঁকা। গত ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন ইলিশ আহরণ বন্ধ ছিল। এই সময় জেলেরা মাছ ধরার জালগুলো সংস্কার করছেন। আরেকটি ট্রলারের জেলে আবদুল কাদের (৪৫) বলেন, ‘করোনাকালে লাখো জেলে পরিবারের দিন কাটছে অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে। জেলেদের পাশে কেউ নেই। আগে মাছ ধরা বন্ধ থাকলে জীবিকার বিকল্প হিসেবে কয়েক হাজার জেলে শহরে টমটম, রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতাম। করোনাকাল-লকডাউনের কারণে এবার সেই সুযোগও নেই।’

ফিশারিঘাট বাজারের অধিকাংশ ইলিশ ঢাকা, চট্টগ্রাম, ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে কক্সবাজার মৎস্য ব্যবসায়ী ঐক্য সমবায় সমিতি। সমিতির সদস্যসংখ্যা ১ হাজার ১০০। বাজারে কথা হয় এ সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও মৎস্য ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীনের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর সমিতির সদস্যরা অন্তত ৪ হাজার মেট্রিক টন ইলিশসহ ১০ হাজার টন সামুদ্রিক মাছ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করেছেন। চলতি বছরের প্রথম আড়াই মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) সরবরাহ করা হয় বিপুল ইলিশসহ ৬ হাজার মেট্রিক টন মাছ। কিন্তু লকডাউনের কারণে গত ২০ মার্চ থেকে ব্যবসা বন্ধ আছে। মাছ বিক্রির প্রায় কয়েক শ কোটি বকেয়া টাকা তুলতে না পেয়ে দিশেহারা সমিতির হাজারো সদস্য।

বামউক কক্সবাজারের ব্যবস্থাপক মো. জাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই পাইকারি বাজার থেকে সামুদ্রিক মাছ বিক্রি হয়েছে ১১ হাজার ১৪ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ইলিশ ছিল ৪ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। এর বিপরীতে সরকারের রাজস্ব আদায় হয়েছে ৮৬ লাখ ২১ হাজার টাকা। আগের অর্থবছরে ৯ হাজার ৬০৫ মেট্রিক টন মাছের বিপরীতে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছিল ৫৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। যার মধ্যে ইলিশ ছিল ৩ হাজার ৬৩৫ মেট্রিক টন। কিন্তু টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সেন্ট মার্টিন থেকেও ১০ হাজার মেট্রিক টন ইলিশসহ অন্তত ২০ হাজার মেট্রিক টন সামুদ্রিক মাছ বেচাবিক্রি হলেও এসব মাছ থেকে সরকারি রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা নেই।

জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, গত বছর জেলায় মাছ উৎপাদিত হয়েছে ২ লাখ ৪৯ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে ইলিশ ছিল ৩৫ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন, চিংড়ি ২৫ হাজার মেট্রিক টন ও অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের মাছ ছিল ২৬ হাজার মেট্রিক টন। চলতি সালে মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫৫ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে ৩৬ হাজার মেট্রিক টন ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছের পরিমাণ ১ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন।

কক্সবাজার ফিশিং বোট মালিক সমিতির তথ্যমতে, জেলার টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার সদর, চকরিয়া, পেকুয়াসহ আটটি উপজেলায় ছোট–বড় ছয় হাজার ট্রলারে জেলেশ্রমিকের সংখ্যা ৯৮ হাজার ৮০০। এর মধ্যে জেলা মৎস্য বিভাগের নিবন্ধিত জেলে ৪৮ হাজার ৩৪২ জন। ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞায় নিবন্ধিত জেলেরা ৫৬ কেজি করে সরকারি চাল পেয়েছেন। কিন্তু অনিবন্ধিত আরও ৫০ হাজার জেলে এযাবৎ কোনো সহায়তা পাননি।

৫ জুলাই সকালে টেকনাফ সৈকতে দেখা গেছে, কয়েক শ ডিঙি নৌকা (রঙিন) মেরিন ড্রাইভ সড়কের পাশে সারিবদ্ধ অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। পাশের ঝাউবাগানের ভেতরেও পড়ে আছে কয়েক শ নৌকা। সবচেয়ে বিপদে টেকনাফের এসব ক্ষুদ্র নৌকার ৪০ হাজার জেলে। তিন বছর ধরে অধিকাংশ জেলে নাফ নদী ও সাগরে মাছ ধরতে পারছেন না। মাছ ধরার অনুমতি প্রার্থনা করে গত ২ জুন প্রধানমন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপিও দেয় টেকনাফ ক্ষুদ্র নৌকা মালিক সমিতি।

সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুলতান আহমদ বলেন, গভীর সাগরে বড় বড় ট্রলারযোগে ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছ আহরণ বন্ধের জন্য যে আইন তৈরি হয়েছে ২০১৫ সালে, তা এখন টেকনাফের ছোট আকৃতির ডিঙি নৌকার ওপর প্রয়োগ হচ্ছে। এতে টেকনাফের অন্তত ৪০ হাজার জেলে ও নৌকার মালিক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অনেক পরিবারে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ ডিঙি নৌকাগুলো ছোট মাছ ধরে উপকূলের এক কিলোমিটারের মধ্যেই।

কক্সবাজার উপকূলে পড়ে আছে লবণ। কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরুশকুল উপকূলে। ছবি: প্রথম আলো
কক্সবাজার উপকূলে পড়ে আছে লবণ। কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরুশকুল উপকূলে। ছবি: প্রথম আলো

পড়ে আছে ১০ লাখ টন লবণ
কক্সবাজার উপকূলে উৎপাদিত লবণ দিয়েই পূরণ হয় দেশের বার্ষিক জাতীয় চাহিদা। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্যমতে, চলতি মৌসুমের পাঁচ মাসে (১৫ ডিসেম্বর থেকে ১৫ মে পর্যন্ত) জেলার ৫৭ হাজার ৭২২ একর জমিতে লবণ উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ মেট্রিক টন। গত মৌসুমে উদ্বৃত্ত ছিল ৩ লাখ ৮৭ হাজার মেট্রিক টন লবণ। সব মিলিয়ে লবণের মজুত আছে ১৯ লাখ ৪৫ হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন। এবার দেশে লবণের বার্ষিক জাতীয় চাহিদা ধরা হয়েছে ১৮ লাখ ৪৮ হাজার মেট্রিক টন। এ হিসাবে চাহিদার অতিরিক্ত থাকে ৯৭ হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন লবণ।

তারপরও খুশি নন উপকূলের প্রান্তিক চাষিরা। এর কারণ অনুসন্ধানের জন্য ৩ জুলাই বিকেলে এই প্রতিবেদক ঘুরে আসেন লবণ উৎপাদনের অন্যতম এলাকা কক্সবাজার সদর উপজেলার চৌফলদণ্ডী উপকূল। সেখানে অন্তত সাড়ে ৩ হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদিত হয়েছে। চৌফলদণ্ডী গ্রামের চাষির আয়াছুর রহমান (৫৬) বলেন, ‘এবার লবণের বাম্পার উৎপাদন হলেও করোনায় ন্যায্যমূল্য পাওয়া যাচ্ছে না। এক মণ লবণ উৎপাদন করতে যেখানে খরচ গেছে ২৪০ টাকা, অথচ বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়। লোকসান দিয়ে কত দিন লবণ বিক্রি সম্ভব?’

টেকনাফ, চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া উপজেলাতেও লবণের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে দিশেহারা চাষিরা। টেকনাফের সাবরাং এলাকার চাষি আজিজুল হক বলেন, মাঠে প্রতি কেজি লবণের দাম এখন ৩ টাকা। অথচ খুচরা বাজারে প্যাকেটজাত লবণ বিক্রি হচ্ছে ৩০-৩৮ টাকায়। দামের এই তারতম্য তদারকির কেউ নেই।

কক্সবাজার উপকূলে লবণ মজুতের কাজে শ্রমিকেরা। কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরুশকুল উপকূলে। ছবি: প্রথম আলো
কক্সবাজার উপকূলে লবণ মজুতের কাজে শ্রমিকেরা। কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরুশকুল উপকূলে। ছবি: প্রথম আলো

ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় পেকুয়ায় অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে প্রায় তিন লাখ টন লবণ। পেকুয়া উপজেলার মগনামা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শরাফত উল্লাহ বলেন, সেখানেও প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়। টেকনাফ উপজেলাতে এবারও ১০ হাজার একর জমিতে লবণের বাম্পার উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু ন্যায্যমূল্য না পেয়ে হতাশ কয়েক হাজার চাষি। সেখানেও অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে চার লাখ টনের বেশি লবণ। বৃষ্টিতে ভিজে বিপুল লবণ নষ্ট হচ্ছে বলে জানিয়েছেন টেকনাফ লবণ ব্যবসায়ী ও চাষি কল্যাণ সমিতির সভাপতি শফিক মিয়া। দেখা গেছে, বিক্রি না হওয়ায় অনেকে উৎপাদিত লবণ মাটির নিচে গর্ত খুঁড়ে মজুত করছেন। কেউ কেউ মাটির ওপর স্তূপ করে রাখা লবণ পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে রাখেন। এলাকায় লবণ সংরক্ষণের জন্য সরকারি-বেসরকারি গুদাম অথবা বিকল্প ব্যবস্থা নেই।

বিসিক কক্সবাজার লবণ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের উপমহাব্যবস্থাপক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, চাহিদার অতিরিক্ত লবণ উৎপাদিত হওয়ায় এ বছর বিদেশ থেকে আর লবণ আমদানি করতে হবে না। বর্তমানে কক্সবাজার উপকূলে মজুত আছে ১০ লাখ টন লবণ। কিন্তু লবণের দাম কমে যাওয়ায় চাষিরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন।

জেলায় ৪৪ হাজার প্রান্তিক চাষিসহ লবণ উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবসায় যুক্ত আছেন অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ। চাষিদের অভিযোগ, করোনাকালে কোনো চাষি পরিবার সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা পায়নি। এ প্রসঙ্গে বিসিক কক্সবাজার লবণ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের পরিদর্শক মো. ইদ্রিস আলী প্রথম আলোকে বলেন, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলার ২৮ হাজার ৭৯১ জন চাষিকে সহজ শর্তে ব্যাংকঋণ প্রাপ্তির চেষ্টা চালাচ্ছে বিসিক। ইতিমধ্যে চাষিদের তালিকা কক্সবাজারের আঞ্চলিক ব্যাংক শাখাসমূহে পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৪ শতাংশ সুদেই লবণচাষিরা ঋণসুবিধা পাবেন।