ঠিকানা তাঁদের ২ নম্বর প্ল্যাটফর্ম দিনাজপুর রেলওয়ে স্টেশন

সারা দিনের কাজ শেষে রাতে স্টেশনে ফিরে মুঠোফোনে ভিডিও দেখেন তফিজনসহ অন্যরা। সম্প্রতি দিনাজপুর রেলস্টেশনে
ছবি: প্রথম আলো

১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১। রাত প্রায় ১০টা। দিনাজপুর রেলস্টেশনের ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মের পশ্চিম প্রান্ত থেকে ভেসে আসে সাপের বিনের সুর। খানিকটা সামনে এগোতেই সুরের রহস্য বোঝা গেল। ষাটোর্ধ্ব চার বৃদ্ধা কম্বল মুড়ি দিয়ে গা ঘেঁষে বসা। সামনে ইটের ওপর হেলান দেওয়া ছোট একটি মুঠোফোন। তাতে চোখ লাগিয়ে দেখছিলেন বেদের মেয়ে জোসনা সিনেমার ভিডিও চিত্র।

আলাপচারিতায় জানা গেল তফিজন, কমলা, মর্জিনা, ধেউলি বেওয়ার বাড়ি সৈয়দপুরের জাদুরহাট চাড়ালকাটা নদীর পারে বড়ুয়া ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে। ৮ বছরের বেশি সময় ধরে এই প্ল্যাটফর্মেই রাত কাটে তাঁদের। সারা দিন একসঙ্গে ভিক্ষা করে সন্ধ্যায় স্টেশনে আসেন। প্ল্যাটফর্মের পাশেই পরিত্যক্ত ভবনের বারান্দায় রান্না হয়। খাওয়া শেষে চাটাই বিছিয়ে শুয়ে পড়েন প্ল্যাটফর্মে। রাত ১১টায় দ্রুতযান এক্সপ্রেস ছেড়ে যাওয়া পর্যন্ত মুঠোফোনে গান শুনে, ভিডিও দেখে সময় কাটান। কখনো গল্প করেন অনেক রাত অবধি। ঘুম না আসা অবধি গল্প চলে ‘বুবু এইবার শীত এংনা বেশি পরোছে, নাতিটা মোর বড় হোই গেইসে কিংবা গেলবার অমুকে একটা কম্বল দিয়া গেইছিলো’ ইত্যাদি সব আলাপ। এর বেশি চিন্তা করে না তফিজনেরা।

চারজনই স্বামীহারা। তিনজনের ছেলেমেয়ে থাকলেও নিঃসন্তান ধেউলি বেওয়া। কথা প্রসঙ্গে ধেউলি বলেন, ‘স্বামী, ছাওয়া–পুতা নাই বাবা, বাড়িও নাই। মরণের অপেক্ষা করোছি।’ বলতে বলতে গলা ধরে আসে ধেউলির। কথা কেড়ে নিয়ে তফিজন বলেন, ‘ছাওয়া নাই, মেয়ে একটা। বিয়াও দিছু। রাস্তাঘাটত যদি মরি যাও মেয়েটা যেন খবর পায়, এইতানে গেল বছর মোবাইল কিনি দিছে।’

শাকের আঁটিতে মাথা রেখে ঘুম

তফিজন-কমলাদের মতো এই প্ল্যাটফর্মে রাত কাটে সহিদা-কালাম দম্পতির। ২০ বছরের বেশি সময় ধরে শাক বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন তাঁরা। দিনাজপুরের বিরল উপজেলার মঙ্গলপুর ইউনিয়নের উত্তর রঘুনাথপুর গ্রামের বাসিন্দা তাঁরা। সকাল আটটায় দিনাজপুর রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে পঞ্চগড়ের উদ্দেশে রওনা হন। দুজনের হাতে দুটি চটের বস্তা। পঞ্চগড়ের কিসমত, গোয়ালপাড়া, মাগুরা, ফুটকিবাড়ি, মির্জাপুরসহ বিভিন্ন জায়গা ঘুরে আখখেত, গম ও ভুট্টাখেতসহ রাস্তার ধার থেকে সংগ্রহ করেন বথুয়া, ঘিমা ও ঢেঁকিশাক। রাত আটটার ট্রেনে চেপে ফেরেন দিনাজপুর স্টেশনে। বস্তাভর্তি শাক বেছে-ধুয়ে পরিষ্কার করে আঁটি বাঁধেন। ভোরে বাহাদুর বাজারে সে শাক বিক্রি করে ১০টার ট্রেন ধরে শাক সংগ্রহ করতে যান আবার পঞ্চগড়ে।

পানিম্যান শাহিন

পুরোনো বিয়ারিং দিয়ে তৈরি একটি ঠেলাগাড়ি। তাতে বসানো নীল রঙের ড্রামভর্তি পানি। স্টেশনের ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ১০টি দোকান। প্রতিটিতে পানি সরবরাহ করেন মো. শাহিন (৪৫)। সকাল-সন্ধ্যা কল থেকে পানি এনে দোকানগুলোতে সরবরাহ করেন। বিনিময়ে দোকানপ্রতি পান ২০ টাকা। শাহিন প্ল্যাটফর্মে পরিচিতি ‘পানিম্যান’ হিসেবে।

ঠিক কবে থেকে এ কাজ করছেন, তা জানা নেই শাহিনের। ছোটবেলায় মা-বাবা হারিয়ে ট্রেনে চেপে গাইবান্ধা থেকে দিনাজপুরে আসেন শাহিন। এরপর থেকে তাঁর ঠিকানা দিনাজপুর রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্ম। টিকে থাকার চেষ্টা করতে করতেই একসময় শুরু করেন পানি সরবরাহের কাজ।

এখন এলাকা থেকে পরিচিত কেউ এলে শাহীনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। শাহীন তাদের নিয়ে আশপাশের দোকানে ভাত খাওয়ান। নানা গল্প করেন। রাতের শেষ ট্রেনটা প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে গেলে ঘুমিয়ে পড়েন। এ জীবনে যেন এর বেশি সুখ চাওয়ার নেই তাঁর।