‘ডর লইয়্যা বইয়া থাকলে সন্তানগো মুখে খাওন জুটব না’

গাজীপুর শহরের রাজবাড়ী ঢালে সড়কবাতির আলোয় ডাব বিক্রি করছেন সুমনা
ছবি: প্রথম আলো

অটোরিকশাচালক স্বামীর আয়ে বেশ ভালোই চলছিল সুমনার সংসার। বছরে অন্তত একবার নতুন জামা, সন্তানের লেখাপড়া আর নিত্যকার খরচ জুগিয়ে চলে যাচ্ছিল দিন। কিন্তু এর মধ্যেই হঠাৎ সামনে আসে স্বামীর বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন। যে স্বপ্ন অদৃষ্টের লিখনের মতো সুমনাকে গৃহবধূ থেকে করেছে গৃহপরিচারিকা, রাস্তার চা বিক্রেতা থেকে নগরের ডাব বিক্রেতা। শহর যখন নীরব, মানুষ যখন ঘরে ফেরায় ব্যস্ত, তখনো সড়কবাতির আলোয় চলে তাঁর জীবনযুদ্ধ। ক্রেতা পাওয়ার আশায় নির্জন শহরে চলে তাঁর হাঁকডাক।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে সুমনার সঙ্গে দেখা হয় গাজীপুর শহরের রাজবাড়ী ঢালে। সন্ধ্যারাতের বৃষ্টি আর সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস হওয়ায় সেদিন একটু আগেভাগেই ফাঁকা হয় রাস্তাঘাট। চারদিক নির্জন। সুমনা বসে আছেন সড়কবাতির নিচে একটি চেয়ারে। পাশেই ডাবভর্তি ভ্যান। অনেকক্ষণ পরপর দু-একজন পথিক হেঁটে আসতে দেখলেই উঠে এসে দাঁড়াচ্ছেন ভ্যানের পাশে। কিন্তু কেউ ডাব না কিনলে পরক্ষণেই মন খারাপ করে আবার বসে পড়ছেন চেয়ারে।

এর মধ্যেই হেঁটে যাওয়া এক তরুণকে দেখে সুমনার আকুতিসূচক ডাক, ‘ও মামা, একটা ডাব খাইয়্যা যান...আর মাত্র এই কয়ডা ডাব বাকি।’ তরুণ ঘুরে দাঁড়ালেন। একটা ডাব কিনলেন। এবার ডাব খেতে খেতে সুমনার কাছে তাঁর জিজ্ঞাসা—‘এত রাতে একা বসে আছেন, নিরাপত্তা নিয়ে আপনার ভয় করছে না?’ দৃঢ়কণ্ঠে সুমনার উত্তর, ‘পেটে খিদা থাকলে মনের ভয়ে কাজ হয় না। ডর লইয়্যা বইয়া থাকলে সন্তানগো মুখে খাওন জুটব না, নিজেরও না খাইয়্যা মরণ লাগব। গরিবের ডরভয় থাকন নাই।’ তরুণের বুঝতে বাকি রইল না, সুমনার মতো মানুষের জন্য ‘পৃথিবী গদ্যময়’।

সুমনা প্রতিদিন একটি নির্দিষ্টসংখ্যক ডাব বিক্রির লক্ষ্য নিয়ে রাস্তায় নামেন। সেদিনও তা–ই করেছেন। কিন্তু বৃষ্টির কারণে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম বিক্রি হয়। ১৫টি ডাব এখনো অবিক্রীত। তাই রাতের সঙ্গে গভীর হচ্ছিল তাঁর কপালের চিন্তার ভাঁজ। কারণ, এই ১৫টি ডাব বিক্রি না হলে চালানের টাকা উঠবে না। পরের দিন মহাজনের দাদন খেতে হবে। তাই রাত বেশি কি কম তা নিয়ে ভাবছেন না।

গৃহবধূ থেকে নগরের নারী ডাব বিক্রেতা হয়ে ওঠার গল্প বলেন সুমনা। তাঁর বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলায়। প্রায় ছয় বছর আগে বিয়ে হয় একই এলাকার মো. শাহজাহানের সঙ্গে। বিয়ের পর থেকেই তাঁরা থাকেন গাজীপুরের তরুবীথি এলাকার ভাড়া বাসায়। শাহজাহান ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালক। তিনিও (সুমনা) বেশ কয়েক বছর কাজ করেছেন একটি পোশাক কারখানায়। পরে ছোট ছেলের জন্ম হলে চাকরি ছেড়ে ঘরেই থাকা শুরু করেন তিনি। তখন থেকে স্বামীর একার আয়ে চলছিল সংসার।

এর মধ্যে এক দিন হঠাৎ বিদেশে যাওয়ার কথা জানান শাহজাহান। সুমনা প্রথমে রাজি হননি, পরে পরিবারের কথা ভেবে মত দেন। বিদেশে যেতে টাকা লাগবে ছয় লাখ। পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে জোগাড় হয় চার লাখ। বাকি দুই লাখ কোনোভাবেই জোগাড় হচ্ছিল না। এরপর বাধ্য হয়ে সুমনা যোগাযোগ করেন এক ঋণদাতা মহাজনের সঙ্গে। মাসিক ২০ হাজার টাকা মুনাফার শর্তে ঋণ নেন ২ লাখ টাকা। এরপর সব মিলিয়ে ছয় লাখ টাকা জমা দেন এক পরিচিত ব্যক্তির কাছে। কিন্তু দুই বছর পার হয়ে গেলেও তাঁর স্বামীকে বিদেশে নিতে পারেননি ওই ব্যক্তি। এদিকে ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে ঋণের বোঝা।

সুমনা জানান, শাহজাহানের প্রতি মাসে গড়ে আয় ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে ঘর ভাড়া ছয় হাজার টাকা। বাকি আট হাজার টাকায় খাওয়াসহ সংসারের অন্যান্য খরচ চালিয়ে কোনোভাবেই সুদের টাকা জোগাড় হচ্ছিল না। এ নিয়ে শুরু হয় পারিবারিক অশান্তি। পরে বাধ্য হয়ে সুদের টাকা জোগাড় করতে সুমনা কাজ নেন গৃহপরিচারিকার। কিন্তু কোলের শিশু (এক বছর) থাকায় কোথাও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারছিলেন না। পরে একজনের পরামর্শে শুরু করেন চা বিক্রির কাজ। কিন্তু সেখানেও বাধ সাধেন স্থানীয় কিছু লোক। সুমনার ভাষায়, ‘নেতারা চা-সিগারেট খেয়ে বিল দেন না।’ তাই বাধ্য হয়ে এ কাজও বাদ দিতে হয় তাঁকে। পরে আরেকজনের পরামর্শে নগরের রাস্তায় শুরু করেন ডাব বিক্রি।

এসব বলতে বলতে একপর্যায়ে কেঁদে দেন সুমনা। তিনি বলেন, ‘বিদেশ বিদেশ কইরা আমার সংসারটা শেষ হইয়্যা গেল। সুদের টাকা দিতে না পাইরা ঘরের জিনিসপত্র বেচ্চি, ট্যাকার কারণে মাইয়্যাডার স্কুল যাওয়া বন্ধ করছি, এমনকি আমি একটা মাইয়্যা মানুষ হইয়া রাইবিরাতে রাস্তায় পইড়া আছি। কতজনে কত কথা কয়, সবই মুখ বুইজ্যা সহ্য করণ লাগে।’ কিছুক্ষণ পর নিজেই শান্ত হয়ে মোছেন চোখের পানি।

ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ১২টা ৩৫ মিনিট। এখনো সুমনার ১০টি ডাব অবিক্রীত। মোটামুটি ক্রেতার আশা ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু তিনি কি একা যাবেন, এমন প্রশ্নে সুমনার উত্তর, ‘একা যাওয়ার সাহস করি না। যতই হোক, আমি মাইয়্যা মানুষ। মনে তো একটু ভয় আছেই। কেউ যাতে মন্দ কিছু না ভাববার পারে, হেইললাইগ্যা সড়কের সবচেয়ে বেশি আলো দেওয়া বাতিডার নিছে বইছি। বাবুর আব্বা (শাহজাহান) রিকশা গ্যারেজে রাইখা আমারে নিতে আইব।’

কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এলেন শাহজাহান। সঙ্গে তাঁর দুই শিশু তানিয়া ও তামিম। তামিম মাকে দেখেই কান্না শুরু করে। সুমনা বুকে তুলে নেন তামিমকে, বুঝতে পারেন, এটা সারা দিন মাকে কাছে না পাওয়ার কান্না। এরপর সুমনা দুই সন্তানকে নিয়ে দ্রুত ভ্যানে উঠে বসেন। শাহজাহান সেই ভ্যান চালিয়ে যাচ্ছেন বাড়ির দিকে।

যাওয়ার আগে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদকের উদ্দেশে সুমনা বলেন, ‘আমাগো কথা লেইখ্যা কী হইব। আমরা গরিব, সারা জীবন গরিবই থাকুম। এক সপ্তাহ না খাইয়্যা থাকলেও কেউ একবার জিগ্যায় না। সরকারের এত উন্নয়ন, এত কিছু—এগুলা আমাগো লাইগ্যা না।’