ডাকাত সরদার এখন সবজির ব্যবসায়ী

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

পাড়ার বেশির ভাগ লোকের ‘পেশা’ ছিল ডাকাতি। এ কারণে পরিচিতি ডাকাতপাড়া নামে। সেই পাড়ার সরদার আবদুল বাকী। ১২টি ডাকাতি মামলার আসামি। তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদেরও পেশা ছিল ডাকাতি। সেই বাকী ডাকাতি ছেড়ে দিয়েছেন। এখন তিনি সবজির ব্যবসায়ী।

আবদুল বাকীর (৫৫) বাড়ি গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার সাতারপাড়া গ্রামের নিজপাড়া গ্রামে। ১০ মাস হলো ডাকাতি ছেড়েছেন তিনি। এখন বেতকাপা ইউনিয়নের ডাকঘর বটতলা বাজারে সবজি বিক্রি করেন। এলাকাবাসীকে নিয়ে সহকারী পুলিশ সুপার (সি-সার্কেল) মো. আসাদুজ্জামান তাঁর পুনর্বাসনে সহযোগিতা করছেন।

জানতে চাইলে বেতকাপা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ফজলুল করিম গতকাল বৃহস্পতিবার বলেন, প্রায় দশ মাস হলো আবদুল বাকী ডাকাতি ছেড়ে দিয়েছেন। এরপর থেকে এলাকায় চুরি-ডাকাতিও তেমন হয়নি। তাঁরা আবদুল বাকীর খোঁজখবর রাখছেন। এর মধ্যে আবদুল বাকী চুরি-ডাকাতিতে জড়িত হননি।

এএসপি মো. আসাদুজ্জামান জানান, সাতারপাড়া গ্রামটি অন্যসব গ্রামের মতোই সবুজ মাঠ আর গাছপালায় ঢাকা। কিন্তু এই গ্রামের নিজপাড়া ছিল চোর-ডাকাতের আঁতুড়ঘর। এখানকার লোকজনের সঙ্গে অন্য গ্রামের কেউ ছেলেমেয়ের বিয়ে দিতে চাইতেন না। তাঁদের মতে, চোর-ডাকাতের সঙ্গে আবার কিসের আত্মীয়তা! বছরখানেক আগে আসাদুজ্জামান গাইবান্ধায় যোগ দেওয়ার পর বিষয়টি জানতে পারেন। তিনি পাড়াটিতে স্বাভাবিক পরিবেশ ফেরানোর উদ্যোগ নেন। কিন্তু ভাবলেন, গোটা পাড়ার মানুষকে একসঙ্গে বদলানো সম্ভব নয়। তাই একজনকে বেছে নেন তিনি—আবদুল বাকী।

ইউপির ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমার গ্রামেই ডাকাতপাড়া ছিল। এতে লজ্জা পেতাম। অন্য এলাকায় পরিচয় দেওয়া যেত না। জনপ্রতিনিধি হয়ে আমরা যা পারিনি, এএসপি স্যার সেটা পেরেছেন। আমরা তাকে সহযোগিতা করেছি। আবদুল বাকী স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসায় অন্যরাও চুরি-ডাকাতি ছেড়ে দিচ্ছেন।’

পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, আবদুল বাকী ‘ডাকাতপাড়া’র নেতা গোছের একজন। তাঁর পরিবারের সবাই ‘পেশাগত’ভাবে ডাকাত। সম্প্রতি তাঁর এক ভাই বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। আসাদুজ্জামানের চেষ্টা ও কঠোর পুলিশি তৎপরতার কারণে ডাকাতিতে সুবিধা করতে না পেরে তাঁর মানসিকতায় পরিবর্তন আসে। তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন।

আবদুল বাকী বলেন, তাঁর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সহজ ছিল না। ডাকাতি ছাড়লেও মামলা তাঁর পিছু ছাড়েনি এখনো। সংসারের খরচ নির্বাহ করা তাঁর জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। কেউ তাঁকে দিনমজুরের কাজও দিতে চাইতেন না। তাঁর চোখে সমাজটাকে বড্ড অচেনা লাগে। সেখানে তিনি একান্তই অনাহূত একজন। তাঁর ভালো থাকার সংকল্প টলতে শুরু করে। তখন তাঁর হাত ধরেন স্ত্রী। বিষয়টি এএসপি মো. আসাদুজ্জামানের নজরে আসে। আসাদুজ্জামান এলাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর পুনর্বাসনের জন্য আর্থিকভাবে সহায়তা করেন। ডাকঘর বটতলা বাজারে তাঁকে সবজির দোকান দিয়ে দেন আসাদুজ্জামান।

সাতারপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আকরাম হোসেন বলেন, গাইবান্ধা-পলাশবাড়ী সড়কের সাকোয়া সেতুতে প্রায়ই রাতে ডাকাতি হতো। সাতারপাড়া গ্রামের ডাকাতেরাই এর সঙ্গে জড়িত ছিল। আবদুল বাকী ডাকাতি ছেড়ে ব্যবসা করছেন। এতে তাঁর সহযোগীরাও ডাকাতি করতে সাহস পাচ্ছেন না। ফলে এই সড়কে প্রায় দশ মাস ধরে ডাকাতি হচ্ছে না।

আবদুল বাকী বলেন, ‘আমি যে খারাপ কাজ করছিলাম, তা বুঝতে পেরেছি। ওসব করে লাভ নেই। শুধু যন্ত্রণা। রাতে ঘুমানো যায় না। তাই এএসপি স্যারের কথায় এসব ছেড়ে দিয়েছি। এখন সৎভাবে বাঁচার জন্য সবজির ব্যবসা ধরেছি। এই এলাকায় আর কাউকে ডাকাতি করতে দেব না। করলে আমি তাঁকে খুঁজে বের করব। আপনারা সহযোগিতা করবেন।’

জানতে চাইলে এএসপি আসাদুজ্জামান বলেন, ‘বাকীকে দীর্ঘদিন নজরদারিতে রেখেছিলাম। তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন। আমি মনে করি, সব সময় আইন দিয়ে সবকিছুর সমাধান হয় না। মানুষকে বুঝিয়ে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে ফল ভালো পাওয়া যায়। বাকীর মতো যাঁরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার চিন্তা করছেন, তাঁদের জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে পুনর্বাসনে সহযোগিতা করা হবে।’