তবু ৪০ জনকে জমি দিলেন ঝুরমান বেওয়া

নিজের ঝুপড়িঘরের সামনে ঝুরমান বেওয়া (৬৩)প্রথম আলো

নিজের বাড়িঘর নেই। বৃদ্ধ বয়সে অন্যের বাড়িতে ফুটফরমায়েশ খেটে কোনোরকম বেঁচে আছেন তিনি। সারা দিন পর রাতে বোনের বাড়ির পাশের এক ঝুপড়িতে কাটান রাত। অথচ ভূমিহীন হিসেবে সরকারের কাছ থেকে পত্তন নেওয়া ৮০ শতক জমি বাড়িঘর নির্মাণ করতে ৪০ জন ভূমিহীনকে দিলেন ষাটোর্ধ্ব এই নারী। আজ শনিবার এ–সংক্রান্ত কাগজপত্র উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করেছেন তিনি।

এই ষাটোর্ধ্ব নারীর নাম ঝুরমান বেওয়া। তিনি নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার কৈচরপাড়ার মরহুম কছিম উদ্দিনের মেয়ে।

বাগাতিপাড়া ইউএনও কার্যালয় সূত্র জানায়, ৬৩ বছর বয়সী ঝুরমান বেওয়ার এক ভাই ও তিন বোন। নাটোর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামের হাতেম আলীর সঙ্গে ৪০ বছর আগে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। স্বামীর বহুবিবাহের কারণে সংসারে তিনি বেশি দিন টিকতে পারেননি। সাত মাসের ছেলে নিয়ে চলে আসেন দরিদ্র বাবার বাড়িতে। বাবার মৃত্যুর পর জীবিকার প্রয়োজনে গ্রামে ফেরি করে মাটির হাঁড়ি–পাতিল বিক্রি করতেন। ছেলে (৩৭) বড় হয়ে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে চলে যান। এদিকে বয়স বাড়ায় ফেরি করে হাঁড়ি–পাতিল বিক্রিও বন্ধ হয় ঝুরমান বেওয়ার। অগত্যা অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে কোনোরকম বেঁচে আছেন তিনি। সারা দিন পর রাতে বোনের বাড়ির পাশের এক ঝুপড়িতে রাত কাটান।

নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রিয়াঙ্কা দেবীর হাতে নিজের পত্তন নেওয়া ৮০ শতক জমির কাগজপত্র হস্তান্তর করছেন ষাটোর্ধ্ব ঝুরমান বেওয়া
প্রথম আলো

এই দারিদ্র্যের জীবনেও স্থানীয়দের মাধ্যমে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯১ সালে ঝুরমান বেওয়া সরকারের কাছ থেকে ভূমিহীন হিসেবে ৯৭ শতক খাসজমি বন্দোবস্ত পান। তবে সেই জমি শুধু কাগজে–কলমেই রয়ে গেছে। অর্থের অভাবে ২৯ বছরেও এই জমিতে বাড়িঘর করতে পারেননি তিনি। এই জমি কাজে লাগিয়ে তিনি ভাগ্যও বদলাতে পারেননি। তাই শেষ বয়সে এসে তিনি ওই জমির মধ্যে ৮০ শতক জমি ভূমিহীনদের বাড়ি করতে দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

সরকার জমি দিলেও টাকার অভাবে ওই জমিতে আমি ঘর তুলতে পারিনি। চাষাবাদ করার সামর্থ্যও আমার নাই। তাই যাদের ঘরবাড়ি নাই, তাদের ঘরবাড়ি করতে ৮০ শতক জমি দিয়া দিছি। আমি খুশিমনেই দিছি।
ঝুরমান বেওয়া

ঝুরমান বেওয়া তাঁর ইচ্ছার কথা জানালে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হস্তান্তরের কাগজপত্র তৈরি করে দেন। শনিবার দুপুরে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে সেই কাগজপত্র ইউএনওর হাতে তুলে দেন এই ষাটোর্ধ্ব নারী। এ সময় জামনগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুল কুদ্দুস, উপজেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক গোলাম মোস্তফা, জামনগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি লোকমান হাকিম, জামনগর ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা ইউসুফ আলী, বাঁশবাড়িয়া ভূমিহীন সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোত্তালেব প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

ঝুরমান বেওয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার জমি দিলেও টাকার অভাবে ওই জমিতে আমি ঘর তুলতে পারিনি। চাষাবাদ করার সামর্থ্যও আমার নাই। তাই যাদের ঘরবাড়ি নাই, তাদের ঘরবাড়ি করতে ৮০ শতক জমি দিয়া দিছি। আমি খুশিমনেই দিছি।’

বাগাতিপাড়ার ইউএনও প্রিয়াঙ্কা দেবী পাল বলেন, ‘ঝুরমান বেওয়া দরিদ্র হতে পারেন, কিন্তু সম্পদে লোভ নেই তাঁর। তিনি নিজের স্বার্থের দিকে না তাকিয়ে তা ৪০ জনকে বাড়ি নির্মাণের জন্য তাঁর জমি দিয়ে দিয়েছেন। এটা কয়জন পারে? আমি তাঁকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।’