তাঁদের দোষ ইটভাটার জন্য জমি দেননি

ফসলি জমিতে গড়ে উঠছে ইটভাটা
প্রথম আলো

টিনের তৈরি বাড়িঘর। বেড়ার টিনের গায়ে দায়ের কোপের দাগগুলো এখনো স্পষ্ট। এসব বাড়িঘর থেকে নির্মাণাধীন একটি ইটভাটার দূরত্ব খুব বেশি নয়। চারপাশে কৃষি জমির মাঝখানে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে ইটভাটাটি। অভিযোগ উঠেছে, এই ইটভাটার কারণে কৃষকদের বাড়িঘরে হামলা চালানো হয়েছে। উল্টো চাঁদাবাজি ও লুটের মামলার আসামি করা হয়েছে ওই কৃষকদেরই। কারণ কৃষকেরা ইটভাটাটির পরিসর বাড়াতে ফসলি জমি দিতে রাজি হননি।

গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার সাজাইল ইউনিয়নের মাজড়া (ডাঙ্গা মাজড়া) গ্রামে এই ইটভাটার অবস্থান।

এদিকে প্রশাসন জানিয়েছে, ওই ইটভাটা অবৈধ। এটি নির্মাণের জন্য কৃষি বিভাগের অনাপত্তিপত্র ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রও নেননি মালিকপক্ষ।

আর মালিকপক্ষের ভাষ্য, সব কাগজপত্র ঠিক করে ইটভাটা চালানো সম্ভব নয়। আর হামলা–মারামারি দুই পক্ষই করেছে।

গ্রামবাসীর অভিযোগ, ইটভাটাটি সম্প্রসারণ করতে চায় মালিকপক্ষ। এ জন্য তাদের আবদার, আশপাশের কৃষিজমিগুলো ছেড়ে দিতে হবে। তাতে রাজি না হওয়ায় জমির মালিক কৃষকদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়েছেন ভাটামালিকের লোকজন। হামলা চালিয়েও ক্ষান্ত হননি ভাটামালিক। কৃষকদের হয়রানি করার জন্য দিয়েছেন চাঁদাবাজি ও লুটের মামলা।

৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে মাজড়া গ্রামে গিয়ে কথা হয় বেশ কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে। তাঁদের একজন কৃষক বাশার সিকদার (৩৫)। তিনি জানান, লিটা ব্রিকস নামের ওই ইটভাটার পাশে তাঁর পরিবারের তিন একর জমি আছে। ইটভাটা সম্প্রসারণ করতে ওই জমি চান ভাটামালিক আবদুর রহমান। কৃষক বাশার বা জমির অন্য মালিকেরা তাতে রাজি নন। এ কারণে তাঁদের বাড়িঘরে গত ১৫ আগস্ট হামলা করা হয়েছে। রামদা, লোহার রড ও লাঠি নিয়ে এ হামলায় অংশ নেন ১৫-২০ জন। হামলাকারীরা ঘরবাড়ি ভাঙচুরের পাশাপাশি সামনে যাকে পেয়েছেন, তাঁকেই মারধর করেছেন।

কৃষক বাশার সিকদার অভিযোগ করে বলেন, ‘আমাদের তিন একর জমির মধ্যে ৯০ শতক আগেই আবদুর রহমান জোর করে দখলে নিয়েছেন। আমাদের অনুমতি না নিয়েই জমিতে ইট রেখেছেন। এতে জমিটি চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে গেছে। ১৫ আগস্ট আমরা জমিতে ধান লাগাতে গিয়েছিলাম। এ সময় আমাদের ওপর লোকজন নিয়ে হামলা করেন আবদুর রহমান। একপর্যায়ে আমাদের ঘরবাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়।’

১৮ আগস্ট বাশার সিকদারের চাচাতো ভাই অপু সিকদার (২৮) কাশিয়ানী থানায় ভাটামালিক আবদুর রহমানসহ মোট ১৩ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা ৫-৬ জনকে আসামি করে মামলা করেন। আবদুর রহমান পরে ২১ আগস্ট অপু সিকদারসহ ৮-১০ জনের নামে আদালতে পাল্টা মামলা দেন। আসামিদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও লুটের অভিযোগ আনেন তিনি, যাকে পুরোপুরি সাজানো ঘটনা বলছেন গ্রামবাসী।

গ্রামবাসীর অভিযোগ, ২০১৮ সালে মাত্র ৯০ শতক জমিতে আবদুর রহমান এই ইটভাটার কার্যক্রম শুরু করেন। নিজের জমির পাশে অল্প কিছু জমি ইজারাও নিয়েছিলেন। ভাটা চালুর পরপরই এটি সম্প্রসারণের জন্য আশপাশের কৃষিজমি করায়ত্ত করতে প্রভাব খাটানো শুরু করেন। মালিকদের অনুমতি ছাড়াই জমিতে ইট রাখতে শুরু করেন। এতে জমিগুলো ধীরে ধীরে চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। তখন কৃষিজমিগুলো কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দেন তিনি। তাতে যাঁরা রাজি হননি, তাঁরাই পড়েছেন রোষানলে। কিছু জমি জোর করে দখলে নেন আবদুর রহমান।

কৃষকদের বাড়ি–ঘরে হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছে
প্রথম আলো

ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পাশেই আবদুর রহমানের লিটা ব্রিকস। ভাটামালিক আবদুর রহমানের বিষয়ে কথা বলতে চাইলেন না কেউই। ভেতরে গিয়ে দেখা গেল, পাঁচ-ছয়জন শ্রমিক ভাটার অবকাঠামো নির্মাণের কাজ করছেন। পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভাটামালিক আবদুর রহমানের ছেলে মাসুম মোল্লা (২১)। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও পারা যায়নি। মিনিট পাঁচেক তাঁর কাছে দাঁড়িয়ে থেকেও কথা বলতে ব্যর্থ হন এই প্রতিবেদক।

পরে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে লিটা ব্রিকসের মালিক আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ইটের ভাটার জন্য জমি চাইতে কয়েকজন মুরব্বিকে পাঠিয়েছিলাম সিকদার বাড়িতে। তাঁরা ওই মুরব্বিদের অপমান করেন। এ নিয়ে তাঁদের সঙ্গে মারামারি হয়েছে।’

চাঁদাবাজি ও লুটের মামলা দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অনেক দিন আগে আমি ইটভাটা থেকে ফিরছিলাম। পথে আমাকে মারার জন্য ঘেরাও করেন আসামিরা। তাই আমি তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছি।’

গোপালগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা আ. কাদের সরদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাশিয়ানীতে লিটা ব্রিকস নামের কোনো ইটভাটা করার জন্য আমাদের কাছ থেকে কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি।’

গোপালগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আসাদুর রহমান বলেন, অবৈধ ইটভাটার তালিকা করে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ভেঙে দেওয়া হবে।

ইটভাটার জন্য বৈধ কাগজপত্র আছে কি না, জানতে চাইলে লিটা ব্রিকসের মালিক আবদুর রহমান বলেন, ‘সব কাগজ ঠিক করে ইটভাটা চালানো সম্ভব নয়। সেটা হলে দেশের কেউই ইটভাটা চালাতে পারবে না।’

এ ব্যাপারে কাশিয়ানী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রথীন্দ্রনাথ রায় ৫ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাজড়া গ্রামের ইটভাটাটি নিয়ে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। আমি ঢাকায় প্রশিক্ষণে আছি। তাই পরিস্থিতি শান্ত করতে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আতিকুল ইসলামকে ঘটনাস্থলে পাঠিয়েছিলাম। আমি প্রশিক্ষণ থেকে ফিরে সরেজমিনে গিয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।’