তারাগঞ্জে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে প্রচারণা চালাচ্ছেন প্রার্থীরা

আচরণবিধি মানছেন না রংপুরের তারাগঞ্জের প্রার্থীরা। নিয়ম না মেনে ঘরে দেয়ালে দেয়ালে প্রতিযোগিতা করে সাঁটানো হয়েছে পোস্টার। ব্র্যাক মোড়, তারাগঞ্জ, ২৬ নভেম্বর
ছবি: রহিদুল মিয়া

রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচন তৃতীয় ধাপে ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। প্রতীক বরাদ্দের পর নির্বাচনকে ঘিরে চলছে প্রার্থীদের জমজমাট প্রচারণা। প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় আচরণবিধি লঙ্ঘন করে ইচ্ছামতো প্রচারকাজ চালাচ্ছেন প্রার্থী।

উপজেলার নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এবারও দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন হচ্ছে। এ উপজেলায় ৫৫ হাজার ৮৫২ জন পুরুষ ভোটার ও ৫৫ হাজার ১৫৬ নারী ভোটার আছেন। পাঁচটি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে ৩০ জন, সংরক্ষিত আসনে সদস্যপদে (নারী) ৭১ জন এবং সাধারণ আসনের (পুরুষ) সদস্যপদে ১৭৮ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

ইউপি নির্বাচন আচরণবিধি ২০১৬ অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানের দেয়াল, যানবাহনে পোস্টার, প্রচারণাপত্র লাগানো যাবে না। নির্বাচনের পূর্বসময়ে কোনো প্রকার মিছিল, মহড়া দেওয়া যাবে না। বেলা দুইটার আগে ও রাত আটটার পর মাইকিং করা যাবে না। কিন্তু এসবের কোনো কিছুকে তোয়াক্কা করছেন না প্রার্থীরা। তাঁরা ভোর থেকে শুরু করে রাত দুইটা পর্যন্ত চালাচ্ছেন প্রচারণা। করছেন মোটরসাইকেল শোডাউন। রাত আটটার আগে প্রচারণা বন্ধ থাকার কথা থাকলে সব ইউনিয়নে রাত ৮টার পর জনসভা শুরু হয়ে রাত ১২-১টা পর্যন্ত চলছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাসাবাড়ির দেয়ালে সাঁটানো হয়েছে পোস্টার। হোটেল–রেস্তোরাঁয় চলছে ভোটারদের খাওয়ানো। মোটরসাইকেল মহড়ার পর দেওয়া হচ্ছে তেল।

আজ শুক্রবার উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, জমে উঠেছে হাটবাজারের পান ও চায়ের দোকানগুলো। সেখানে ভিড় করছেন বিভিন্ন প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকেরা। চা পানের পাশাপাশি চলছে ভোট প্রার্থনা। বসতবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দেয়ালে দেয়ালে প্রতিযোগিতা করে সাঁটানো হয়েছে পোস্টার।

ইকরচালী ব্র্যাক মোড়, জগদীশপুরের মোড়, হাতিবান্ধার বাজার, কাশিয়াবাড়ির বাজার, বুড়িরহাটের বাজার, অনন্তপুরের মোড়, চিকলীর বাজারসহ উপজেলার বিভিন্ন সড়কের পাশের বাড়িগুলো যেন পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেছে।

জগদীশপুর মোড়ে কথা হয়, শাহপাড়া গ্রামের ভোটার ভুট্টু মিয়ার (৪০) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মেম্বার–চেয়ারম্যানেরা কোনো আইনকানুন বুঝছেন না। পাকা ঘরের দেয়ালোত, রাস্তার ধারের গাছতও পোস্টার নাগাওছে। প্রশাসনের লোক এগুলা দেখির আইসোছে না। হামরা বাধা করলেও শোনোছে না। প্রার্থীর লোকজন ইচ্ছে মতোন পোস্টার নাগাওছে।’

মাটিয়ালপাড়ার দোলায় আমন ধান কাটতে ব্যস্ত ওই গ্রামের কৃষক টন্না মিয়া (৫০)।

আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘ভোট হামার ঘুম হারাম করি দিছে। মাঝ রাইতোত প্রার্থীরা ঘরোত আসি কান্নাকাটি করি ভোট চাওছে। যতক্ষণ উঠমেন না ততোক্ষণ দরজাত ঠোকঠোকায়। এক প্রার্থী চলি যাবার পর আরেক প্রার্থী আইসে।’ওই গ্রামের আরেক গৃহবধূ রোশনা খাতুন (৪৫) বলেন, ‘দিনে রাইতে মাইকিংয়ের আওয়াজোত কান ঝালাপালা হয়া যাওছে। সকাল থাকি মাইকোত ভোটের গান বাজা শুরু হয় শেষ হওচে দুপুর রাইতোত। কারও মাইকিংয়ের গাড়ি সারা রাইত গ্রামোত ঘোরোছে। ছাওয়ার ঘরে ঘুম, লেখাপড়া শেষ। আইনের লোক এগুলো কেন যে বন্ধ করোছে না, তাক আল্লায় জানে।’বরাতির মোড়ে বসে আছেন ৯-১০ জন।

ভোটের বিষয়ে জানতে চাইলেই বরাতি জামে মসজিদের ইমাম সাদেকল ইসলাম বলেন, ‘ভোটের জন্য শান্তিমতো নামাজ–কালামও পড়া যাচ্ছে না। নামাজের সময়েও প্রার্থীর লোকেরা মিছিল–মিটিং–মাইকিং করোছে।’সয়ার ইউনিয়নের চিলাপাক বাজারে কথা হয়, কাংলাচড়া গ্রামের লুৎফর রহমান (৩০) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সকালে হাটোত আলচি থাকি ভোটের চা বিড়ি খাওছি। কোনো খরচ নাই। যতক্ষণ বাজারোত আছি প্রার্থী, প্রার্থীর লোকেরা ডাকে নিগি নাস্তা, চা–বিড়ি খাওয়াওছে।’

হাড়িয়ারকুঠি ইউনিয়নের শেখপাড়া গ্রামের শিক্ষার্থী জেমিন শেখ আক্ষেপ করে বলেন, ‘কেউ তো এলাকায় নির্বাচনী আচরণবিধি মানছেন না। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত একের পর এক ভোটের মাইক উচ্চ স্বরে বাজছে। আবার ঘরে ঘরে প্রার্থীর লোকজন আসি ভোট চাচ্ছে। না পারছি ঠিকমতো ঘুমোতে, না পারছি লেখাপড়া করতে।’

হাড়িয়ারকুঠি ইউনিয়নের সরকারপাড়া গ্রামের ভ্যানচালক সোনা মিয়া (৩০) বলেন, ‘নির্বাচন আসি যেমন কামাইও হওচে, তেমন যন্ত্রণাও হইচে। ভোটের পরে যেন কারও শত্রু না হই। সেই জন্যে রাইত জাগি সবারে মিটিংও যাই।’

দেয়ালে পোস্টার লাগানোর বিষয়ে জানতে চাইলে ইকরচালী ইউনিয়নের সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্যপ্রার্থী মালেকা বেগম বলেন, ‘ভাই, শুধু আমি তো আচরণবিধি লঙ্ঘন করিনি। অন্য প্রার্থীর লোকেরাও তো দেয়ালে পোস্টার লাগাইছে।’

জানতে চাইলে উপজেলা নির্বচন কর্মকর্তা সাদ্দাম হোসেন বলেন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পুরো উপজেলা ঘুরে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছেন। কোনো প্রার্থী নির্বাচনী আচরণবিধি অমান্য করলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।