তালপাতার ছাউনির নিচে রহমান শেখের বসতি

তালপাতার ছাউনির নিচে রহমান শেখের বসতি। শুক্রবার সকালে উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের ফৈজদ্দিন মাতুব্বর পাড়ায়
ছবি: এম রাশেদুল হক

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার ফৈজদ্দিন মাতুব্বর পাড়ার রহমান শেখের বয়স এখন ৭২ বছর। একসময় তাঁর জমি, বাড়ি অনেক কিছুই ছিল। ধারদেনাসহ নানা কারণে সব হারিয়েছেন। ভাগ্যের ফেরে এখন তিনি নিঃস্ব। বাবার একখণ্ড জমিতে তালপাতার ছাউনির নিচে কাটছে তাঁর মানবেতর জীবনযাপন। শীত, কুয়াশা ও রোদ-বৃষ্টি সবই পার কারছেন তালপাতার ওই ছাউনির ঘরে।

রহমান শেখের স্ত্রী হাজেরা বেগম গৃহকর্মীর কাজ সূত্রে থাকেন রাজবাড়ীর গান্ধিমারা এলাকার এক পরিচিতজনের বাড়িতে। একমাত্র ছেলে হাসিবুল শেখ বিয়ে করে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে চলে গেছেন ঢাকায়। বাবা-মায়ের এখন খোঁজ নেন না তিনি।

শুক্রবার সকালে উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের ফৈজদ্দিন মাতুব্বর পাড়া (গাজীর ডাঙ্গী) গ্রামে সরেজমিনে দেখা যায়, কৃষিজমির পাশে একখণ্ড পতিত জমিতে তালপাতা দিয়ে ঘেরা রহমান শেখের ঘর। দেখে মনে হবে, সবজির খেত পাহারা দিতে খুপরি ঘর তৈরি করা হয়েছে। আসলে সেটি তাঁর আবাসস্থল।

আলাপকালে রহমান শেখ বলেন, ফৈজদ্দিন মাতুব্বর পাড়া গ্রামে নিজস্ব বাড়ি ছিল তাঁর। স্ত্রী হাজরা বেগম ও একমাত্র ছেলে হাসিবুলকে নিয়ে ছিল তাঁর সংসার। অভাবের কারণে ২৪-২৫ বছর আগে চাচাতো ভাই কেসমত শেখের কাছে জমি বিক্রি করে গ্রামের আরেক জায়গায় যান তিনি। সেখানে নিজের সাত কাঠা জমিতে বসবাস শুরু করেন। প্রায় ১০ বছর থাকার পর ধারদেনা হয়ে গেলে আপন ভাই জহির উদ্দিনের কাছে দেড় লাখ টাকায় জমি বিক্রি করে যান উপজেলার দৌলতদিয়া ইউনিয়নের ফৈদাল মাতুব্বর পাড়ায়। সেখানে আট কাঠা জমির ওপর দুটি চৌচালা টিনের ঘর করে বসবাস শুরু করেন। স্থানীয় কিছু অসাধু ব্যক্তির ষড়যন্ত্রের শিকার হন। তাঁর ছেলে হাসিবুল বিভিন্ন গ্রাম থেকে টাকা ধার নিয়েছেন বলে কয়েকজন অভিযোগ তোলেন।

প্রায় সাত লাখ টাকা ধার নিয়েছেন বলে দ্রুত ওই টাকা পরিশোধে তাঁকে চাপও দেওয়া হয়। একপর্যায়ে তাঁকে (রহমানকে) আটকে রেখে জোর করে জমিসহ বাড়ি লিখে নিয়ে এলাকা ছাড়া করা হয়।

খড়ের বিছানা ও তালপাতার ছাউনির নিচে রহমান শেখের একাকী সংসার
ছবি: প্রথম আলো

স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে রহমান শেখ আশ্রয় নেন এক স্বজনের বাড়িতে। দুই বছর আগে ছেলে হাসিবুল তাঁর স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে ঢাকায় চলে যান। একা হয়ে পড়েন রহমান শেখ। ঠাঁই নেন রাজবাড়ীর গান্ধিমারার পরিচিত একজনের বাড়িতে। কাজের লোক হিসেবে স্ত্রীকে সেখানে রেখে ফৈজদ্দিন মাতুব্বর পাড়া চলে আসেন তিনি। কয়েক দিন অন্যের বাড়ি থাকার পর ১০ নভেম্বর বাবার দুই কাঠা পতিত জমিতে তালপাতার ছাউনির ঘর তোলেন। এখন সেই ঘরেই তাঁর বসতি, একাকী সংসার। এখন কেউ দিনমজুর হিসেবে কাজে নিলে দুই বেলা খাবার ও ২০০-৩০০ টাকা মজুরি পান। যেদিন কাজ পান না, সেদিন চিড়া খেয়ে থাকতে হয়। উপজেলা প্রশাসন থেকে সরকারি ঘর পাওয়ার আশ্বাস পেয়েছেন। ঘর পেলে স্ত্রীকে কাছে নিয়ে আসার ইচ্ছা আছে তাঁর।

প্রতিবেশী জালাল শেখ বলেন, সম্পর্কে রহমান শেখ চাচা হন। একসময় তাঁর জমি, বাড়িঘর ছিল। দিন দিন তিনি সব হারিয়ে এখন নিঃস্ব। তাঁর বাড়ির সামনে পৈতৃক দুই কাঠা পতিত জমিতে তালপাতার ছাউনি দিয়ে খড়ের বিছানায় থাকেন রহমান।
স্থানীয় ইউপি সদস্য নুরুজ্জামান খবির বলেন, ‘বিষয়টি তাঁর জানা ছিল না। সে কোনো দিন আমার কাছে আসেনি। উপজেলা প্রশাসন বিষয়টি জানার পর তাঁর থাকার ঘরের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে বলে জেনেছি।’

গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আজিজুল হক খান বলেন, কয়েক দিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে তালপাতার ছাউনির নিচে ওই ব্যক্তির বসবাসের খবর জেনেছেন। তাৎক্ষণিকভাবে তাঁকে একটি সরকারি ঘর বরাদ্দের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সেখানে মাটি ফেলা হচ্ছে। শিগগিরই মুজিব বর্ষ উপলক্ষে তাঁকে একটি পাকা ঘর করে দেওয়া হবে।