তিন প্রজন্মের ব্যবসা বন্ধ হতে পারে, তবু তাঁরা খুশি

সেতু চালুর পর ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেলে কীভাবে সংসার চলবে সেই চিন্তায় ব্যবসায়ীরা। এরই মধ্যে কেউ কেউ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অন্যত্র স্থাপনা সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন।

সালাম চোকদার (৬০) ১৯৮৬ সালে বাবা দিনা চোকদারের সঙ্গে পদ্মা নদীর তীরে কাওড়াকান্দিতে চা ও খাদ্যপণ্যের দোকান দেন। তখন তিনি ২৪ বছরের তরুণ। ১৯৯৫ সালে বাবার মৃত্যুর আগপর্যন্ত বাবা-ছেলে একসঙ্গে দোকান সামলেছেন। এই দোকানের আয়ে মা–বাবা, সালাম, তাঁর স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানের সংসার ভালোভাবেই চলেছে। এখন দোকানটি সামলাচ্ছেন সালামের ১৮ বছরের ছেলে জোনায়েদ। দীর্ঘ ৩৬ বছরে প্রমত্ত পদ্মার ভাঙা-গড়ার কারণে কয়েক দফা দোকানের স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে। এখন দোকানটি মাদারীপুরের শিবচরের বাংলাবাজার ঘাটে।

২৫ জুন পদ্মা সেতু চালুর পর সালামের তিন প্রজন্মের দোকানটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সালাম চোকদার প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘বাবা হাতে ধরে দোকানে আমাকে বসিয়েছেন। দোকানটির আয় দিয়ে তিন ছেলে ও দুই মেয়েকে পড়ালেখা করিয়ে বড় করেছি। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। দুই ছেলে অন্য কাজ করে। ছোট ছেলে (জোনায়েদ) তিন বছর ধরে আমার সঙ্গে দোকান করছে।’

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সালাম বললেন, ‘তিন প্রজন্মের ব্যবসাটি হয়তো আমাকে ছাড়তে হবে। পদ্মা সেতু চালু হচ্ছে, মানুষের দীর্ঘদিনের ভোগান্তির অবসান হবে, এটি অন্য রকমের আনন্দ। কিন্তু ৩৬ বছরের বেঁচে থাকার অবলম্বন বন্ধ হতে পারে, এটি অনেক বেদনার।’

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লউটিএ) সূত্র জানায়, সেতু চালুর পর শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌপথ বন্ধ হয়ে যাবে। শিমুলিয়া-জাজিরা নৌপথে সীমিত পরিসরে ফেরি চলাচল করবে। তবে যাত্রী পারাপার বন্ধ থাকবে। সে ক্ষেত্রে ঘাটে লোকজনের আনাগোনা কমে যাবে। এতে হোটেলসহ অন্যান্য দোকানের প্রয়োজন কমে যাবে।

ফেরিঘাটকে কেন্দ্র করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা করেছেন শরীয়তপুরের মানুষেরা। এখন তাঁরা বিকল্প চিন্তা করতে শুরু করেছেন
ছবি: প্রথম আলো

শিবচরের সলু ব্যাপারী কান্দি গ্রামের ফেরদৌস হাওলাদার কাওড়াকান্দি ট্রলার ঘাটে রেস্তোরাঁর ব্যবসা চালু করেন ১৯৮৮ সালে। ২০১৪ সালে ফেরদৌস মারা গেলে ছেলে সাত্তার হাওলাদার ব্যবসার হাল ধরেন। এখন মাওয়া-কাওড়াকান্দি নৌপথের বাংলাবাজার ঘাটে সাত্তার (৫৫) ও তাঁর ছেলে আমীন হাওলাদার (২২) রেস্তোরাঁর ব্যবসা চালাচ্ছেন। সেতু চালুর পর ঘাটে মানুষের চলাচল থাকবে না। বন্ধ করে দিতে হবে তাঁদের তিন প্রজন্মের রেস্তোরাঁর ব্যবসা। সরেজমিনে দেখা যায়, এরই মধ্যে কেউ কেউ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের স্থাপনা সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন।

আমীন হাওলাদার প্রথম আলোকে বললেন, ‘দাদার হোটেলটি আব্বা চালাচ্ছেন। পাঁচ বছর ধরে আমি তাঁকে সহায়তা করছি। পদ্মা সেতু আমাদের গৌরবের স্থাপনা। এটি ঘিরে এই অঞ্চলের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। তখন হয়তো আমি একটি কাজ জুটিয়ে নিতে পারব। এ বয়সে এসে আব্বা আর কী করবেন?’

এই রেস্তোরাঁই তাঁদের পরিবারের আয়ের একমাত্র উৎস জানিয়ে সাত্তার বললেন, ‘নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যেও ব্যবসাটি টিকিয়ে রেখেছি। ৩৪ বছর পর পরিবারের ব্যবসাটি বন্ধ হয়ে যাবে, এমনটা ভাবলেই দুঃখ হয়। তারপরও পদ্মা সেতু হচ্ছে, এলাকা উন্নত হবে, এটি ভেবে আনন্দিত হচ্ছি।’

২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি জেলাকে সারা দেশের সঙ্গে সড়কপথে যুক্ত করবে পদ্মা সেতু। এই সেতুর মাধ্যমে মোংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে।

চলাচল সহজ করার পাশাপাশি অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে পদ্মা সেতু। এক সমীক্ষা অনুযায়ী, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ হারে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ।