তুষার রাজ্যে বাঙালি অভিযাত্রী

কলম্বাস, ম্যাগেলান, ক্যাপ্টেন কুক কিংবা ডেভিড লিভিংস্টোনের মতোই আবিষ্কারের নেশায় ছুটেছিলেন শরৎচন্দ্র। চট্টগ্রামের পটিয়ার আলমপুরের এই সন্তান এখনো বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষের কৌতূহলের বিষয়। সিনেমার চরিত্রের মতোই তাঁর জীবন।

শরৎচন্দ্র দাশ

চারদিকে শুধু তুষারের সমুদ্র। আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বরফে ঢাকা অসংখ্য পাহাড় সাদা সাদা মাথা তুলে বিষণ্ন আকাশটা ছুঁয়ে আছে। আকাশে তারা জ্বলছে, কিন্তু কেমন নিবু নিবু। দূর থেকে মাঝেমধ্যে কানে আসছে তুষারধসের শব্দ। একটা সময় তুষারাবৃত গিরিপথ অতিক্রম করে গেলাম। প্রকৃতির এই অপরূপ মূর্ত-স্তব্ধ-শান্ত-মোহময় রূপ আগে কখনো দেখিনি। সেই অনিন্দ্য প্রাকৃতিক শোভা আমাকে এতটাই মুগ্ধ করেছে যে আজও তার বর্ণনার ভাষা খুঁজে পাই না।

শরৎচন্দ্র দাশের লেখা ‘আ জার্নি টু লাসা অ্যান্ড সেন্ট্রাল টিবেট’ বইয়ের দেবাংশু দাশগুপ্তের করা বাংলা অনুবাদ ‘তিব্বতে দুবার’ থেকে বিবরণটি তুলে দেওয়া হয়েছে। আজ থেকে ১৪০ বছর আগে ১৮৮১ সালের ৩০ নভেম্বর তিব্বতের কোনো এক পার্বত্য পথের বিবরণ লিখে গেছেন শরৎচন্দ্র দাশ। অতীশ দীপঙ্করের পর তিনিই প্রথম বাঙালি, যিনি হিমালয়ের তুষারাচ্ছাদিত শৃঙ্গ পাড়ি দিয়ে তখনকার নিষিদ্ধ ও বিচ্ছিন্ন জনপদ তিব্বত গিয়েছিলেন। মোট দুবার তিনি তিব্বত ভ্রমণ করেছিলেন। পাশ্চাত্য দুনিয়ার কাছে তিনিই প্রথম তুলে ধরেছিলেন তিব্বতের সমাজ, সংস্কৃতি ও বৌদ্ধ দর্শনের নানা ইতিবৃত্ত। এ ছাড়া লিখেছিলেন ভ্রমণকাহিনি, তিব্বতি ভাষার অভিধান ও সেদেশের সংস্কৃতি নিয়ে একাধিক বই। কেবল অভিজ্ঞতা আর জ্ঞান অর্জন নয়, তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভূরাজনৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করলে শরৎচন্দ্রের দুই দফা তিব্বত অভিযান বিশেষ গুরুত্ববাহী।

কলম্বাস, ম্যাগেলান, ক্যাপ্টেন কুক কিংবা ডেভিড লিভিংস্টোনের মতোই আবিষ্কারের নেশায় ছুটেছিলেন শরৎচন্দ্র। চট্টগ্রামের পটিয়ার আলমপুরের এই সন্তান এখনো বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষের কৌতূহলের বিষয়। সিনেমার চরিত্রের মতোই তাঁর জীবন। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক ও সাময়িকীগুলোতে তাঁকে নিয়ে এখনো আলোচনা চলছে। নিয়মিতই ছাপা হচ্ছে প্রবন্ধ-নিবন্ধ। তবে বেশির ভাগ জায়গায় তাঁকে চিত্রিত করা হয়েছে ভারতীয় গুপ্তচর হিসেবে। আনন্দবাজার পত্রিকায় পর্জন্য সেনের লেখার শিরোনাম ছিল ‘পণ্ডিত গুপ্তচর’। নিউইয়র্ক টাইমস-এ সোমনাথ সুব্রামানিয়ানের লেখার শিরোনাম, ‘দা ইন্ডিয়ান স্পাই হু ফেল ফর টিবেট’।

দা গ্রেট গেম

শরৎচন্দ্র দাশের ওপর আতশি কাচ ধরার আগে আসুন একবার দেখে নেওয়া যাক তখনকার ভূরাজনীতির চালচিত্র। উনিশ শতকে রাশিয়া ও ব্রিটিশ ভারতের মধ্যে এক প্রলম্বিত শীতল যুদ্ধ চলছিল। ইতিহাসবিদেরা এই শীতল যুদ্ধের নাম দিয়েছিলেন গ্রেট গেম। জার শাসিত রুশ সাম্রাজ্য এশিয়ার আফগানিস্তান, তিব্বতসহ অনেক অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট ছিল। ভারতবর্ষের সীমানায় তিব্বত যদি শত্রুদেশের প্রভাববলয়ে চলে যায়, তবে তা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একধরনের পরাজয়। এ জন্য বহির্বিশ্বের জন্য নিষিদ্ধ অঞ্চল তিব্বতে বরাবরই অভিযান চালাতে চেয়েছে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। উনিশ শতকে ভারত ও তিব্বতের মধ্যে বাণিজ্যপথ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করত তিব্বতি ও সীমান্ত অঞ্চলের পাহাড়ি উপজাতিরা। তারা ছাড়া এই পথ ব্যবহারের অনুমতি পেতেন কেবল বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। অগত্যা এই নিষিদ্ধ অঞ্চল সম্পর্কে জানতে সেখানে গুপ্তচর পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। পাহাড়ি লোকজন থেকে বেছে গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলো। তাদের পাঠানো হলো বৌদ্ধ ভিক্ষুর ছদ্মবেশে। কিন্তু কোনো অভিযানই সাফল্যের মুখ দেখল না। শেষে শরৎচন্দ্র দাশের দুই দফা তিব্বত অভিযান ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে সে দেশের মানচিত্র তৈরি, যাত্রাপথ ও গুরুত্বপূর্ণ সেনাছাউনির হদিস জানতে সহায়তা করেছিল। এরপর ব্রিটিশ সমরনায়ক ইয়ংহাসবেন্ড তিব্বতে সেনা অভিযান পরিচালনা করে সে দেশকে সন্ধি করতে বাধ্য করেছিলেন।

কিন্তু শরৎচন্দ্র দাশকে ‘জেমস বন্ড’ বা তুখোড় কাউন্টার ইন্টেলিজেন্ট ভাবলে ভুল হবে। তিনি একজন গুপ্তচরের চেয়েও অধিক কিছু ছিলেন। কেন বলছি সে কথা, পরিষ্কার করব নিচের লেখায়। তার আগে আসুন তাঁর ঠিকুজি কুলজি জেনে নিই।

শরৎ বৃত্তান্ত

ইতিহাসবিদ ও গবেষক সুনীতিভূষণ কানুনগো তাঁর ‘শরৎচ্চন্দ্র দাশ—জীবন ও কর্ম’ বইতে লিখেছেন, চট্টগ্রামের পটিয়ার আলমপুরে ১৮৪৯ সালের ১৮ জুলাই শরৎচন্দ্র দাশের জন্ম। তাঁর বাবা ছিলেন দীন দয়াল দাশ ওরফে মগন ঠাকুর। চট্টগ্রামের কালেক্টরিতে চাকরি নিয়েছিলেন দীন দয়াল। চার ভাইবোনের মধ্যে শরৎচন্দ্র ছিলেন দ্বিতীয়। বিখ্যাত সাহিত্যিক কবি গুণাকর নবীনচন্দ্র দাশ শরৎচন্দ্রের পিঠাপিঠি ছোট ভাই। গ্রামের পাঠশালায় শরৎচন্দ্রের প্রথম শিক্ষাজীবনের শুরু। এরপর সুচক্রদণ্ডীর একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে ভর্তি হয়েছিলেন ইংরেজি মাধ্যমের চট্টগ্রাম হাইস্কুলে। ১৮৭১ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৭৩ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এফএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হন।

নিউইয়র্ক টাইমস-এ লেখক সোমনাথ সুব্রামানিয়ান শরৎচন্দ্রের জীবনের পরের অধ্যায় নিয়ে লিখতে গিয়ে মন্তব্য করেন, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে একজন বাঙালি মধ্যবিত্ত হিসেবে শরৎচন্দ্র হয়তো কলকাতায় তাঁর পরবর্তী জীবন কাটিয়ে দিতেন। হলেন সফল সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু ম্যালেরিয়াই তাঁকে নামজাদা অভিযাত্রীতে পরিণত করে।

এই মন্তব্য খুব একটা বাড়িয়ে বলা নয়। গবেষকেরা জানাচ্ছেন, প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় শরৎচন্দ্র পিলে জ্বর বা ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। ১৮৭৪ সালে ফাইনাল পরীক্ষার সময় অসুস্থ হলেন, সারাক্ষণই ঠকঠকে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর। বাঁচিয়ে দিলেন উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক সি বি ক্লার্ক। দার্জিলিংয়ের ডেপুটি কমিশনার স্যার জন এডগার তত দিনে সেখানকার শিশুদের লেখাপড়ার জন্য ভুটিয়া বোর্ডিং স্কুল তৈরি করেছেন। ক্লার্ক সেখানকার প্রধান শিক্ষক হওয়ার প্রস্তাব দিলেন ছাত্রকে। শরৎচন্দ্র প্রথমে দোনোমোনো করছিলেন। তারপর পাহাড়ি জলহাওয়ায় স্বাস্থ্য উদ্ধার হবে ভেবে সায় দিলেন।

শিল্পীর হাতে অাঁকা তিব্বতের রাজধানী লাসার প্রাচীন মানচিত্র
ছবি: সংগৃহীত

তিব্বতের পথে

যে সময়টার কথা বলা হচ্ছে তখন দার্জিলিং কেন, শিলিগুড়ি যাওয়ারও সহজ রাস্তা ছিল না। কিছু দূর ট্রেন, এরপর লঞ্চ, তারপর আবার গরুর গাড়িতে চড়ে পৌঁছাতে হতো শিলিগুড়ি। সেখান থেকে হেঁটে আর ঘোড়ায় চড়ে কার্সিয়াং, এরপর দার্জিলিং পৌঁছান শরৎচন্দ্র। সেখানে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিষ্ঠিত টিবেটান বোর্ডিং স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যখন যোগ দেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৫ বছর। স্থানীয় লোকজন ওই স্কুলের নাম দিয়েছিল ভুটিয়া স্কুল। পাশের দেশ ভুটান আর সিকিম থেকে আসা শিশুরা পড়ত বলে স্কুলটির এমন নামকরণ। ভুটিয়া স্কুলে যোগ দিয়ে সমস্যায় পড়েছিলেন শরৎচন্দ্র। শিশু ও অভিভাবকেরা কেউ ইংরেজি বোঝে না। আর তিনিও ভুটিয়া, তিব্বতি এসব ভাষার ছিটেফোঁটাও জানতেন না। এই বাধা অতিক্রমে তিনি তিব্বতি ভাষা শিখে ফেলেন। তাঁর স্কুলেই পড়ত সিকিম রাজার ছেলে। সেই সুবাদে তিনি সিকিম ভ্রমণ করার সুযোগ পান। সে যাত্রায় সিকিমের বিখ্যাত পেমা ইয়াংসি মঠের ভিক্ষু উগ্যেন গিয়াৎসুর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় শরৎচন্দ্রের। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, নিষিদ্ধ দেশ তিব্বতের পাঞ্চেন লামার প্রধান সহকারী, তাশি লামার সঙ্গে পরিচয় আছে উগ্যেন গিয়াৎসুর। তাশি লামা ইংরেজি ভাষা, বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিদ্যা—এসব বিষয়ে বেশ উৎসাহী। উগ্যেন গিয়াৎসুর সহায়তায় শরৎচন্দ্র তাশি লুনপো মঠে যাত্রার অনুমতি জোগাড় করেন।

১৮৭৯ সালের ১৭ জুন উগ্যেন গিয়াৎসুর সঙ্গে শুরু হয় তিব্বতের দুর্গম পথে অভিযান। সফরসঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন একজন গাইড ও একজন কুলি। সঙ্গে নিয়েছিলেন জরিপকাজ চালানোর জন্য সেক্সট্যান্ট ক্যামেরা, প্রিজম্যাটিক কম্পাস, হিপসোমিটার, থার্মোমিটার ও ফিল্ড গ্লাস।

দার্জিলিং থেকে পেমিয়াংচি, তারপর কাঞ্চনজঙ্ঘা ধরে জোংরি। যাত্রার সময় শরৎচন্দ্র দাশকে বৌদ্ধ লামার ছদ্মবেশ নিতে হয়েছিল। কাঞ্চনজঙ্ঘার অজানা উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় অঞ্চল অতিক্রম করে নেপাল হয়ে চথং লা পেরিয়ে তিব্বতের তাশি-লুনপোতে পৌঁছেছিলেন তাঁরা। সেখানে উষ্ণ অভ্যর্থনা পান। তিব্বত ভ্রমণের সুবিধার্থে তাশি লুনপো মঠে ছাত্র হিসেবে ভর্তিও হয়ে যান শরৎচন্দ্র। সেই দফায় ছয় মাস মঠে থেকে তিব্বতি ভাষা ও বৌদ্ধধর্ম চর্চা করার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। ফিরে আসার সময় লামার মঠ থেকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন ভারতে হারিয়ে যাওয়া দণ্ডীর কাব্যাদর্শ, কাশ্মীরি কবি ক্ষেমেন্দ্রের ‘অবদানকল্পলতা’ ও চান্দ্র ব্যাকরণের প্রাচীন পুথি। এ ছাড়া তিব্বতের গুরুত্বপূর্ণ পর্বত, হিমশৈলি আর পথপ্রান্তরের স্কেচ।

তাঁর এই অভিযানের কারণেই কাঞ্চনজঙ্ঘার অজানা উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় অঞ্চলগুলোর বিষয়ে একটি প্রাথমিক ধারণা পেয়েছিলেন ইংরেজরা।

দ্বিতীয় দফায় অভিযান

আট বছর বয়সী ত্রয়োদশ দালাই লামা

১৮৮১ সালের নভেম্বর মাসে দ্বিতীয়বার তিব্বত অভিযানে বের হন শরৎচন্দ্র দাশ। সঙ্গে সেই উগ্যেন গিয়াৎসু। এবারও তাশি লুনপো মঠে যাত্রাবিরতি। তারপর সেখান থেকে অনুমতি সংগ্রহ করে লাসা নগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা। ১৮৮২ সালের ৩০ মে লাসা পৌঁছান শরৎচন্দ্র দাশ ও তাঁর দল। এর কয়েক মাসের মধ্যে লাসার পোতলা প্যালেসে তিনি ত্রয়োদশ দালাই লামার সাক্ষাৎ পান। তিনিই একমাত্র বাঙালি, যিনি দালাই লামার সঙ্গে লাসার প্রাসাদে গিয়ে দেখা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। আট বছরের দালাই লামাকে দেখে তাঁর মনে হয়েছিল, বয়সের তুলনায় অনেক পরিপক্ব, কিন্তু দায়িত্বভারে ক্লান্ত। সেই শিশুর কাছে গিয়ে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন বৌদ্ধধর্মের পবিত্র মন্ত্র, ‘ওম মণিপদ্মে হুম।’

দ্বিতীয় দফায় ১৪ মাস ছিলেন তিনি তিব্বতে। সে যাত্রায় খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিব্বতের জনজীবন। গুটিবসন্তে গ্রাম, জনপদ উজাড় হতেও দেখেছেন। অথচ পাশের দেশ ভারতে তখন এ রোগের টিকা সহজলভ্য হয়েছে। কেবল গুটিবসন্ত নয়, জ্বর, অম্বলের মতো সাধারণ রোগে কেমন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে মানুষজন, তা-ও দেখেন তিনি। সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া ওষুধসামগ্রী দিয়ে অনেকের চিকিৎসাও করেছিলেন। এরপর তাঁর ওপর স্থানীয় লোকজনের সম্ভ্রম ও বিশ্বাস জাগতেও শুরু করে। অনেকেই মনে করেছিলেন কাশ্মীরি পণ্ডিত (তাঁকে ওই নামেই চিনতেন তিব্বতিরা) আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী।

দ্বিতীয় অভিযান শেষে শরৎচন্দ্র যখন ভারতে ফিরে আসেন তার কিছুদিনের মধ্যে তিব্বতি কর্তৃপক্ষের সন্দেহ হয় তিনি ব্রিটিশ চর। এ কারণে তিব্বতে তাঁকে সহযোগিতা করার অভিযোগে একাধিক স্থানীয় ব্যক্তি, এমনকি লামাদের মধ্যেও কাউকে কাউকে শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়। এদের কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, আবার কাউকে কারাগারে বন্দী করা হয়েছিল।

লাসা ভিলা

ইংরেজরা দীর্ঘকাল ধরে শরৎচন্দ্র দাশের তিব্বত ভ্রমণের কোনো বৃত্তান্ত প্রকাশ হতে দেয়নি। তবে ভিক্টোরিয়ার প্রাসাদ থেকে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদক সিআইইতে ভূষিত করা হয় তাঁকে। দেওয়া হয় ‘রায়বাহাদুর’ ও ‘অর্ডার অব ইন্ডিয়ান আম্পায়ার’ খেতাব। হিমালয়ের খুঁটিনাটি অজানা ভৌগোলিক তথ্য আবিষ্কারের জন্য শরৎকে সম্মানিত করে লন্ডনের রয়্যাল জিয়োগ্রাফিক সোসাইটি। কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটির পত্রিকায় তাঁর লেখালেখি খুলে দেয় তিব্বত ও বৌদ্ধ সংস্কৃতিচর্চার নতুন দিগন্ত। শরৎচন্দ্রের সঙ্গে উগ্যান গিয়াৎসুকেও সম্মানিত করেছিল ব্রিটিশ শাসকেরা। রায়বাহাদুর উপাধি পান তিনি।

তিব্বত বিশারদ ও বৌদ্ধধর্মের প্রতি অনুরাগ থেকে পরবর্তীকালে থাইল্যান্ড, চীন ও জাপান সফর করেন শরৎচন্দ্র। সেসব দেশে পান সম্মাননা। বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনচর্চায় তিনি প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগও নিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সরকার তাঁর তিব্বত অভিযানকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগালেও শরৎচন্দ্র সত্যিকার অর্থে এই তুষার আচ্ছাদিত রাজ্যের প্রেমে পড়েছিলেন। তাই জন্মস্থান চট্টগ্রামে আর কখনো ফিরে আসেননি। দার্জিলিংয়ে একটা বাড়ি করে নাম দিয়েছিলেন ‘লাসা ভিলা’। সেই বাড়িতেই নিঃসঙ্গ অবস্থায় ১৯১৭ সালে মৃত্যু হয় তাঁর।

আহমেদ মুনির: কবি ও জে্যষ্ঠ সহসম্পাদক, প্রথম আলো, চট্টগ্রাম অফিস