দক্ষিণাঞ্চলমুখী মানুষের চাপ বাড়ছে, স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই

দক্ষিণাঞ্চলমুখী যাত্রীদের ভিড় বেড়েই চলেছে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ফেরিঘাটে। ফেরিতে যাত্রীদের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে ঘাট কর্তৃপক্ষ। আজ রোববার দুপুরে মাদারীপুরের বাংলাবাজার ফেরিঘাটে
ছবি: অজয় কুন্ডু

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ১৪ এপ্রিল থেকে ‘সর্বাত্মক লকডাউনের’ ঘোষণায় মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া ও মাদারীপুরের বাংলাবাজার নৌপথে দক্ষিণাঞ্চলমুখী যাত্রীদের ভিড় বেড়েই চলেছে। ফেরিতে যাত্রীদের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে ঘাট কর্তৃপক্ষ। কোনো প্রকার স্বাস্থ্যবিধি ছাড়াই ফেরি, স্পিডবোট ও ট্রলারে যাত্রী পারাপার করা হচ্ছে। ফলে বেড়েই চলেছে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি।

এদিকে এক সপ্তাহের জন্য সরকারের দেওয়া ‘বিধিনিষেধের’ শেষ দিন ছিল আজ রোববার। এই এক সপ্তাহ ফেরিতে যাত্রী পারাপার সম্পূর্ণ বন্ধ রাখতে বলা হলেও যাত্রী ও যানবাহনের চাপ বেশি থাকায় গত শুক্রবার থেকে নৌপথে ৬–৭টি ফেরি সচল রাখা হয়েছে। সন্ধ্যার পর থেকে চালু রাখা হচ্ছে ১৫টি ফেরি। অবাধে চলাচল করছে স্পিডবোট ও ট্রলার। তবে বন্ধ রয়েছে লঞ্চ চলাচল।

বিআইডব্লিউটিসি বাংলাবাজার ফেরিঘাট সূত্র জানায়, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকাতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত সোমবার থেকে সাত দিন সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে জরুরি প্রয়োজনে উভয় ঘাটে দুটি ছোট ফেরি চালু রাখতে বলা হয়। কিন্তু গত শুক্রবার থেকে যাত্রী ও কাঁচা মালবাহী ট্রাকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় উভয় ঘাট থেকে ছাড়া হয় ৬ থেকে ৭টি ফেরি। এ ছাড়া রাত ২টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত পণ্যবাহী ট্রাক পারাপারের নির্দেশনা থাকলেও গত শুক্রবার সন্ধ্যার পর থেকে ১৫টি ফেরিতে যাত্রী ও যানবাহন পারাপার হচ্ছে।

রোববার সরেজমিনে বাংলাবাজার ফেরিঘাটে গিয়ে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকা থেকে আসা যাত্রীদের ভিড় প্রতিটি ফেরিতে। গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে যাত্রীরা। নেই কোনো প্রকার স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা। অনেক যাত্রীর মুখে নেই মাস্ক, নেই সামাজিক দূরত্ব। কথা বলে জানা গেল, এসব যাত্রীর বেশির ভাগই শ্রমিক ও দিনমজুর। ঢাকায় কাজ না থাকায় তাঁরা দেশের বাড়িতে যাচ্ছেন। অন্যদিকে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার থেকে আসা যাত্রীরা ঢাকামুখী হচ্ছেন। তাঁদের সংখ্যা কম নয়। তবে ঢাকা থেকে আসা যাত্রীদের ভিড়ই বেশি এই নৌপথে।

যাত্রী ও যানবাহনের চাপ বেশি থাকায় গত শুক্রবার থেকে শিমুলিয়া–বাংলাবাজার নৌপথে ৬–৭টি ফেরি সচল রাখা হয়েছে
ছবি: প্রথম আলো

স্পিডবোট ও ট্রলার চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা হলেও যাত্রীদের একটি অংশ ফেরিতে উঠতে না পেরে স্পিডবোট ও ট্রলারে গাদাগাদি করে পারাপার হচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলমুখী যাত্রীরা বাংলাবাজার ফেরিঘাটে নেমে গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছেন সিএনজি, মাহিন্দ্র, ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল, পিকআপ ভ্যান ও মাইক্রোবাসে করে। দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ থাকলেও সড়কে কিছু লোকাল বাস চলাচল করতে দেখা গেছে।

ফেরিতে পারাপার হওয়া বরিশালগামী যাত্রী সেকেন্দার আলী (৪৫) প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকায় ফেরি করে কাপড় বেচতাম। করোনায় এক সপ্তাহ ধইরা বইসা আছি। কোনো কাম পাই না। যা আয়রোজগার ছিল সব খরচা হইয়া গেছে। ঢাকায় থাকলে তো খরচা লাগে, পেট চালাইতে হয়। সেই টাহা তো নাই। উপায় না পাইয়া গ্রামের বাড়িতে চইলা যাইতাছি।’

ষাটোর্ধ্ব গোপালগঞ্জগামী যাত্রী বাশার ফকির বলেন, ‘করোনারে ভয় না পায়ে ভয় পাই না খাইয়া থাকারে। চায়ের দোহান ছিল, করোনায় এহন বন্ধ ওই দোহান। কাম না করিতে পারলে করোনার চিন্তা কইরা লাভ কী। ঢাকার থোন মেলা কষ্টে বের হইয়া ঘাট পার হইছি। এহনে বাড়ি যাইতে পারলে বাঁচি।’

স্পিডবোটে পার হওয়া যাত্রী কামরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘খালি মুখে মাস্ক পরলেই কি করোনা দূর হবে। বেশির ভাগ যাত্রী মাস্ক পরে কিন্তু নাক–মুখ খোলা থাকে। এমন মাস্ক পরা না–পরা সমান। গাড়িতে, ফেরিতে, স্পিডবোট ও ট্রলারে সবখানে গাদাগাদি। সামাজিক দূরত্ব কোথাও নাই। আমি একা নিয়ম মেনে চললে আর কী হবে?’

স্পিডবোটে করে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌপথ পাড়ি দিচ্ছেন যাত্রীরা
ছবি: প্রথম আলো

বাংলাবাজার ফেরিঘাটের সহকারী ব্যবস্থাপক ভজন সাহা প্রথম আলোকে বলেন, আজ রোববার ঘাটে যাত্রী চাপ খুব বেশি। দেখে মনে হচ্ছে পরশু ঈদ। ঈদের সময় এমন চাপ থাকে। লকডাউনের প্রথম দুই তিন–দিন মোটামুটি ভালো ছিল। এখন আর কোনো অবস্থা নেই। মানুষের মধ্যে করোনা নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। এত বলাবলি করেও যাত্রীদের সচেতন করা যাচ্ছে না। ফেরিতে তাদের ওঠানো কোনোভাবেই আটকানোও সম্ভব হচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, যাত্রীরা ঢাকা থেকে কীভাবে ঘাট পর্যন্ত আসছে। সড়কে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ না করলে যাত্রীরা কোনো না কোনো উপায় ধরে ঘাট পর্যন্ত চলে আসবে। তাই যাত্রীদের ভিড় কমছে না। যাত্রীদের ঠেকাতে হলে সবার আগে মহাসড়কে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

বাংলাবাজার ফেরিঘাটের ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক (টিআই) মো. আশিকুর রহমান বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সব মেনে চলে কিন্তু মানুষ মানে না কিছু। প্রতিটি ফেরিতে ৪০০ থেকে ৫০০ জন করে যাত্রী পারাপার হচ্ছে। করোনা নিয়ে মানুষ সচেতন না হলে কিছু সম্ভব না। তাদের বাধা দিয়ে রাখা যাচ্ছে না। এরপরও ঘাট থেকে কোনো গণপরিবহন চলতে দেওয়া হচ্ছে না। যা চলে চুরিচামারি করে চলে।’