দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীতে জোয়ারের উচ্চতা বাড়ছেই

অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর পানি উপচে নগরে প্রবেশ করেছে। বুধবার বিকেলে নগরের ভাটিখানা এলাকায়।প্রথম আলো

দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীতে জোয়ারের উচ্চতা ক্রমেই বাড়ছে। আগে ঘূর্ণিঝড় হলে নদ-নদীতে অধিক উচ্চতার জোয়ার হলেও এখন অমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ারেও এ অঞ্চলের নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে শহর-বন্দর, অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকায়ও পানি ঢুকে পড়ছে। রাস্তাঘাট হাঁটুপানিতে ডুবছে। লোকালয় এমনকি বসতঘরেও বুকসমান পানিতে প্লাবিত হয়ে দক্ষিণাঞ্চলের লাখো পরিবারকে অসহনীয় দুর্ভোগে ফেলছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বরিশাল কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. মাসুম বলেন, কীর্তনখোলা নদীর পানি গতকাল বুধবার বিকেল ৫টার দিকে বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ৪৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। একই সময়ে মেঘনায় বিপৎসীমার ১০৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি বয়ে গেছে, যা বিগত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আজ বৃহস্পতিবার সকালেও বিষখালী নদীতে বিপৎসীমার ৫৭ সেন্টিমিটার, পায়রায় ৬৪ সেন্টিমিটার এবং বরিশালের কীর্তনখোলায় ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে কীর্তনখোলায় পূর্ণ জোয়ার আসে বিকেলে ৪টার পর।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে উপকূলের নদ-নদীতে জোয়ারের এমন উচ্চতা দেখা যায়নি। বিশেষত বঙ্গোপসাগরে বড় আকারের ঘূর্ণিঝড় হলে এমন উচ্চতার জোয়ার হতো। কিন্তু সাধারণ লঘুচাপের প্রভাবে নদ-নদীর পানি এতটা ফুসে ওঠার ঘটনা এই প্রথম। বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির যে আলোচনা রয়েছে, এটা তারই ফল বলে মনে করছেন তাঁরা। এই পরিস্থিতিকে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে অশনিসংকেত বলেও মনে করছেন তাঁরা।
আবহাওয়া বিভাগের উপাত্ত বলছে, ২০ মে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ধকল কাটতে না কাটতেই গত ২৬ মে সকাল থেকেই উপকূলে ফের আবহাওয়া বৈরী হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে নদ-নদীতে শুরু হয় বিপৎসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত অধিক উচ্চতার জোয়ার। এতে চর ও নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকে ঘরদোর ভাসে। দিনে ও রাতে দুবেলার উচ্চ জোয়ারের দক্ষিণাঞ্চলের লাখো পরিবারে নেমে আসে অসহনীয় দুর্ভোগ। এই ধকল কাটতে না কাটতেই ৪ আগস্ট পুনরায় শুরু হয় উচ্চ জোয়ারের তাণ্ডব। ৮ আগস্ট পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। এরপর গত রোববার থেকে আবার প্রবল বর্ষণের পাশাপাশি শুরু হয়েছে জোয়ারের তাণ্ডব।

নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে বরগুনার আমতলী শহরে
প্রথম আলো

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, বরিশাল বিভাগের বরগুনা, পটুয়াখালী দুই জেলা সাগর সন্নিকটে হওয়ায় এসব জেলার মানুষ উচ্চ জোয়ারের তাণ্ডবের ভুক্তভোগী বেশি। দিনে ও রাতে দুই দফা জোয়ারে ভাসে এসব জেলার লাখো পরিবার।
বরগুনার তালতলী উপজেলার বড়অংকুজান পাড়া গ্রামের পারুল বেগম বলেন, ‘পানিতে ঘরে তরাতে পারি না।’
তালতলীর জয়ালভাঙা গ্রামের বাসিন্দা আরম মিয়া বলেন, ‘জোয়ারের পানিতে ঘরে তরাইতে পারি না। দিনে-রাইতে দুইবার ঘর-দুয়ার বাসে। রান্ধন–খাওন বন্ধ চাইর দিন ধইরা।’

বাড়ছে জোয়ারের উচ্চতা
জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলায় এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছে উপকূলের বাসিন্দারা। এর ওপর এই অঞ্চলের নদ-নদীতে অধিক উচ্চতার জোয়ার নতুন আরেক দুর্যোগ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) জোয়ার পরিমাপক শাখার তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ সালে বরিশাল অঞ্চলের প্রধান নদ-নদী বিষখালী-পায়রা-বলেশ্বরে সর্বোচ্চ জোয়ারের উচ্চতা ছিল ৩ দশমিক ৪৫ মিটার, ২০০৫ সালে ৩ দশমিক ৫১ মিটার, ২০০৬ সালে ২ দশমিক ৯৬ মিটার, ২০০৭ সালে সিডরে জোয়ারের এই উচ্চতা গিয়ে দাঁড়ায় ৪ দশমিক ২২ মিটার আর ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলায় জলোচ্ছ্বাস হয় ৩ দশমিক ৬৫ মিটার। এরপর ২০১৩ সালের ১৬ মের ঘূর্ণিঝড় মহাসেনে জোয়ারের তীব্রতা ছিল ৩ দশমিক ৩৬ মিটার। ওই বছরের ১৫ জুলাই পূর্ণিমার প্রভাবে উপকূলে জোয়ারের উচ্চতা ছিল ৩ দশমিক ৬২ মিটার। ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ আঘাত হানার সময় জোয়ারের উচ্চতা ছিল ৩ দশমিক ১০ মিটার থেকে চার মিটারের মধ্যে। এবারের আম্পানে জোয়ারের উচ্চতা ছিল ৩ দশমিক ৩৬ মিটার থেকে ৪ মিটারের ওপরে। এসব নদীর জোয়ারের স্বাভাবিক মাত্রা হচ্ছে সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৮৫ মিটার। তবে ঘূর্ণিঝড় ছাড়াও এবারের অমাবস্য-পূণির্মার জোয়ারের উচ্চতাও ৪ মিটারের কাছাকাছি ছিল।

এই অবস্থাকে অস্বাভাবিক বলেছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোস্টাল স্টাডিজ অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান হাফিজ আশরাফুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আমাদের নদ-নদী ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির বিষয়টি এখন আলোচিত। কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে এখনো দেশে তেমন গবেষণা কিংবা যথাযথ তথ্য-উপাত্ত আমরা পাচ্ছি না। তবে নদ-নদীগুলো ও সাগরের পরিবেশ-প্রতিবেশে পরিবর্তনটা টের পাচ্ছি। এর ভুক্তভোগী উপকূলের কোটি মানুষ। মূলত অপরিকল্পিত নগরায়ণ, প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো সংকোচন, দখল, পানি ধরে রাখার উৎস কমে যাওয়া এ জন্য দায়ী। এতে নদীগুলোর আন্তসংযোগ বিঘ্নিত হয়ে জোয়ারের উচ্চতাকে বাড়িয়ে তুলছে।
পাউবোর আঞ্চলিক প্রধান কার্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী জাভেদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এবারের অস্বাভাবিক উচ্চতার জোয়ার আমাদের জন্য একটি ভীতিকর ইঙ্গিত (অ্যালার্মিং)। উপকূলে জোয়ারের উচ্চতা অনেক বেড়েছে, এটা এখন নির্দ্বিধায় বলা যায়। এটা জলবায়ু পরিবর্তনেরই প্রভাব। এ জন্য দেশের নদ-নদী ও পানি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিকে গুরুত্ব দিয়ে অদূর ভবিষ্যতে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত।