দখল-দূষণে সংকটে খাকদোন নদ

  • দখলদারদের মধ্যে সাবেক জনপ্রতিনিধি, এমনকি বিশিষ্ট ব্যবসায়ীও রয়েছেন।

  • বরগুনা শহরের ক্রোক থেকে মাছবাজার পর্যন্ত ৩ কিলোমিটারে বিআইডব্লিউটিএর তালিকায় ১৫০ অবৈধ দখলদারের নাম রয়েছে।

দখল-দূষণে বরগুনার প্রাণ খাকদোন নদটি অস্তিত্বসংকটে পড়েছে। দখলমুক্ত করে বড় ধরনের খননকাজ না চালালে অচিরেই একসময়ের প্রমত্তা এই নদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। দখলদারদের মধ্যে সাবেক জনপ্রতিনিধি, এমনকি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী পর্যন্ত রয়েছেন। খাকদোন নদের অস্তিত্ব বিলীন হলে এর সঙ্গে অন্তত ১৫টি প্রাকৃতিক খালেরও মৃত্যু হবে।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, একসময় নদটি পৌনে এক কিলোমিটার প্রশস্ত ছিল। গত দুই দশকে অব্যাহত দখল, রক্ষণাবেক্ষণ ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের অবহেলায় বিষখালী-পায়রা নদীর সংযোগ স্থাপনকারী ২৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ নদের ১৫ কিলোমিটার মরা খালে পরিণত হয়েছে। বাকি ৯ কিলোমিটার নদের অস্তিত্ব থাকলেও এর মধ্যে মাত্র ৬ কিলোমিটার কোনোরকম নৌ চলাচলের জন্য সচল আছে। ওই ছয় কিলোমিটার নদও দুই পাশ থেকে দখল করে সংকুচিত করে গলা টিপে ধরেছে দখলদারেরা। এই নদেই বিআইডব্লিউটিএর নৌবন্দর অবস্থিত।

বরগুনা শহরের ক্রোক থেকে মাছবাজার পর্যন্ত তিন কিলোমিটার এলাকায় বিআইডব্লিউটিএর তালিকায় ১৫০ জন অবৈধ দখলদারের নাম রয়েছে। এর মধ্যে সাধারণ ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধিদের নামও রয়েছে। বরগুনা নদীবন্দরের কর্মকর্তা মামুন অর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রায় সীমানার মধ্যে নদের দক্ষিণ পাড়ে ১৫০ জন অবৈধ দখলদার রয়েছেন। এ ছাড়া খাকদোন নদের উত্তর পাড়ও আমাদের ভেতরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত এর কোনো চিঠি আমরা পাইনি। ওই পাড়ে দুই শতাধিক অবৈধ স্থাপনা রয়েছে।’

এর মধ্যে বরগুনা পৌরসভার সাবেক মেয়র শাহাদাত হোসেন উপজেলা পরিষদের সামনে তাঁর তিনতলা ব্যক্তিগত কার্যালয়ের পেছনে খাকদোন নদ ভরাট করেছেন বলে তথ্য রয়েছে। এ ছাড়া তিনি ক্রোক এলাকায় নদ ভরাট করে সেখানে একটি জেটি নির্মাণ করেছেন। বরগুনা জেলা বণিক সমিতির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি জহিরুল হকের নামও রয়েছে ওই তালিকায়। তিনি দুটি স্থাপনা করেছেন নদ দখল করে।

নদ দখলের তালিকায় নাম থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মেয়র শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘উপজেলা পরিষদের সামনে এবং ক্রোক এলাকায় আমার দুটি স্থাপনা রয়েছে। ওই দুটি স্থাপনায় নদের কিছু অংশ ভরাট হয়ে গেছে। আমি দুটি অংশ পরিষ্কার করে রেখেছি। যখন প্রশাসনে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করবে, তখন আমি ওই অংশ ছেড়ে দেব।’

জহিরুল হক বলেন, ‘আমি নদ দখল করিনি। আমার কোনো অবৈধ স্থাপনা নেই। আমার নাম ব্যবহার করে অপর এক প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতার ছেলের দুটি স্থাপনা রয়েছে।’

এ ছাড়া দখলদারদের তালিকায় আছেন বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আবুল হোসেন তালুকদার, বরগুনা রাইফেল ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান মোল্লা, জেলা বিএনপি সাবেক সভাপতি মাহবুবুল আলম মোল্লার মেয়ের জামাতা বাদল খান, পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফারুক সিকদার, সাবেক বিএনপি নেতা রুস্তম আজাদ, ব্যবসায়ী জসিম নায়ক, মিলন মৃধা নাজিম আলীসহ অনেকে। ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফারুক সিকদার বলেন, ‘আমি নদের জমি দখল করিনি। তবে ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের পাশে এক রিকশাচালক কিছু জমি আমার নামে দখল করে ঘর তুলে সেখানে বসবাস করছে।’

পরিবেশ ও আইনবিদ সমিতির (বেলা) বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী লিংকন বায়েন বলেন, ‘খাকদোন নদের তীরেই বরগুনা শহর। তাই নদটি এই শহর ও পরিবেশ-প্রকৃতির প্রাণ। নদটি দখল হয়ে অস্তিত্বসংকটে পড়ায় আমরা উচ্চ আদালতে রিট আবেদনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। এর আগে এই শহরের ভাড়ানি খাল রক্ষায় আমরা আদালতে রিট করার পর ওই খালের অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে খালটি খনন করা হচ্ছে।’

বিআইডব্লিউটিএ সূত্র জানায়, বরগুনা নদীবন্দর সচল রাখতে প্রায় প্রতিবছর সরকার লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে খাকদোন নদের ছয় কিলোমিটার খনন করে। কিন্তু অব্যাহত দখলের কারণে এই অংশের নাব্যতা ধরে রাখা যাচ্ছে না। এ কারণে নাব্যতা ও অস্তিত্বসংকটের মুখে পড়েছে ওই অংশও।

নদের নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে ২০১০ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত প্রায় প্রতিবছর এ নদের ছয় কিলোমিটার নৌপথ খনন করে বিআইডব্লিউটিএ। কিন্তু খননের কয়েক মাস যেতে না যেতে আবার জোয়ারে পলি পড়ে নদ ভরাট হয়ে যায়। এ ছাড়া নদের দুই পাশ দখলের কারণে নদটি সংকুচিত হয়ে পড়ছে। নদের সঙ্গে শাখাখালগুলোর প্রবেশদ্বারে স্লুইসগেট নির্মাণ করায় জোয়ারের প্রবাহ কমে গিয়ে এসব খালও ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

জানতে চাইলে বরগুনা নৌবন্দরের সহকারী পরিচালক মামুন অর রশিদ বলেন, অব্যাহত দখলে নদটি সংকুচিত হওয়ায় এখানে বড় কোনো লঞ্চ ঘুরতে পারে না। এ জন্য এই বন্দরে বড় ও বিলাসবহুল লঞ্চ আসে না। আর বন্দরের সুফলও পাওয়া যাচ্ছে না।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বরগুনা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী কায়ছার আলম বলেন, খাকদোন নদের উৎসস্থল থেকে পায়রা নদী পর্যন্ত খনন করা হবে। তাঁদের একটি সমীক্ষা কমিটি কাজ করছে। ওই কমিটির প্রতিবেদন দিলেই দু-এক মাসের মধ্যে একটি প্রকল্প প্রণয়ন করে পাউবোর প্রধান কার্যালয়ে জমা দেওয়া হবে।

অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের বিষয়ে জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের কারণে আমাদের উচ্ছেদ অভিযান স্থগিত করা হয়েছিল। আমরা এখন নির্বাচন শেষ করেছি, যেকোনো সময় নদের দুই পাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে।’