দরজায় মই জুড়ে উঠতে হয় ট্রেনে

মই দিয়ে ট্রেনে ওঠানামা করছেন যাত্রীরা। শনিবার সকালে নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার মালঞ্চি রেলস্টেশনে
ছবি: প্রথম আলো

ছোট্ট রেলস্টেশনে অর্ধশতাধিক যাত্রীর জটলা। ট্রেন এসে থামল প্ল্যাটফর্মের বাইরের লাইনে। মুহূর্তে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। কোত্থেকে দুজন এসে ট্রেনের দরজার সামনে জুড়ে দিলেন মই। সেই মই বেয়ে ট্রেনে উঠলেন যাত্রীরা। কেউবা হাতল ধরে ঝুলে ঝুলেও ঢুকলেন ভেতরে।

শনিবার এ দৃশ্য দেখা গেল নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার মালঞ্চি রেলওয়ে স্টেশনে। ট্রেন আসার আগে কথা হয় এখানে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের সঙ্গে। তাঁরা জানান, এ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ট্রেন থামে না। থামে বাইরের লাইনে। তাই মই বেয়ে উঠতে হয়। এ জন্য মাথাপিছু ১০ টাকা দিতে হয়। এতে ঝুঁকিও রয়েছে।

মালঞ্চি রেলস্টেশনে টিকিট কাটার কোনো কাউন্টারও নেই। তাই যাত্রীরা এখান থেকে বিনা টিকিটেই ট্রেনে ওঠেন। এ কারণে বিড়ম্বনায়ও পড়তে হয় তাঁদের। অনেকেই বিনা টিকিটে ভ্রমণের জন্য জেল-জরিমানার শিকার হন।

লোকবলের অভাবে স্টেশনটি ২৪ ঘণ্টা তালাবদ্ধ থাকে। উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে বারবার বিষয়টি জানানোর পরও সমস্যার সমাধান হয়নি।
আবদুল হাদি, ভাইস চেয়ারম্যান, বাগাতিপাড়া উপজেলা পরিষদ

স্টেশনটি সরকারিভাবে বন্ধ করা না হলেও একজন নৈশপ্রহরী ছাড়া কেউ নেই। এখানে প্রহরী হিসেবে আছেন আবদুস সালাম।

আবদুস সালাম জানান, ২০০৩ সাল থেকে এ স্টেশনে জনবল কমতে শুরু করে। ২০০৮ সালে জনবলশূন্য হয়ে পড়ে স্টেশনটি। এখানে একটি সরাসরি এবং প্ল্যাটফর্ম-সংলগ্ন দুটিসহ মোট তিনটি ক্রসিং লাইন রয়েছে। পয়েন্টসম্যান না থাকায় ক্রসিং লাইনে ট্রেনের গতিপথ পরিবর্তন করা সম্ভব হয় না। এ কারণে সব ট্রেন সরাসরি লাইনটি দিয়ে চলাচল করে। এই লাইন নিয়ন্ত্রণ করে মালঞ্চি স্টেশনের দুই পাশের স্টেশন নাটোর ও আবদুলপুর।

আবদুস সালাম বলেন, আগে এ স্টেশনে পাঁচটি ট্রেনে যাত্রী ওঠানামা করতেন। এখন পার্বতীপুর থেকে ছেড়ে আসা রাজশাহীগামী উত্তরা এক্সপ্রেস ও চিলাহাটি থেকে ছেড়ে আসা খুলনাগামী মেইল ট্রেন যাত্রাবিরতি করে। ট্রেন দুটি প্ল্যাটফর্মের বাইরের লাইনে থামার কারণে যাত্রীরা ওঠানামার জন্য মই ব্যবহার করেন। এতে যাত্রীদের, বিশেষ করে নারী, শিশু ও বয়স্কদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়।

মই দিয়ে ট্রেনে ওঠানামা করছেন যাত্রীরা। শনিবার সকালে নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার মালঞ্চি রেলস্টেশনে
ছবি: প্রথম আলো

শনিবার সকালে দেখা গেল, স্টেশনটির প্রধান ফটকে তালা ঝুলছে। স্টেশনমাস্টারের কার্যালয়ের সামনে কুকুর-বিড়াল ও ছাগল ঘুমাচ্ছে। প্ল্যাটফর্ম জনমানবশূন্য। তবে প্ল্যাটফর্মের বাইরে অর্ধশতাধিক যাত্রী ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে।

ইয়াছিন আলী (৬২) নামের এক যাত্রী জানান, রাজশাহীতে ডাক্তার দেখাতে যাওয়ার জন্য তিনি ট্রেনের অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু ট্রেনে উঠবেন কী করে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।

কথা বলতে বলতেই রাজশাহীগামী উত্তরা এক্সপ্রেস ট্রেন এসে প্ল্যাটফর্মের বাইরের লাইনে দাঁড়ায়। মুহূর্তেই দুই ব্যক্তি মই হাতে ছুটে আসেন। তাঁরা ট্রেনের দরজায় মই বসিয়ে যাত্রীদের ওঠানামা করান। বিনিময়ে মাথাপিছু ১০ টাকা নেন।

মশিউর রহমান নামের এক মইওয়ালা বললেন, ‘দুর্বল যাত্রীদের নিরাপদে ওঠানামা করায়ে আমরা পেটের ভাত জোগাড় করি। এতে যাত্রীরা অসন্তুষ্ট হন না।’

নতুন করে জনবল নিয়োগ শুরু হয়েছে। প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দেওয়া হলে স্টেশনটির সমস্যার সমাধান হবে।
অশোক কুমার চক্রবর্তী, স্টেশন মাস্টার, নাটোর

স্টেশনটির পাশেই মালঞ্চি বাজার। সেখানে কথা হয়, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল হাদির সঙ্গে।

আবদুল হাদি বলেন, আশপাশে সড়ক ও নৌ যোগাযোগ না থাকায় ১৯২৭ সালে মালঞ্চি রেলস্টেশন স্থাপিত হয়। এখনো সে অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। স্টেশনের পাশে উপজেলা পরিষদ থাকায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই ট্রেনে যাতায়াত করেন। পাশেই রয়েছে কাদিরাবাদ ক্যান্টনমেন্ট ও বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির (বাউয়েট) মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান। অথচ বর্তমানে লোকবলের অভাবে স্টেশনটি ২৪ ঘণ্টা তালাবদ্ধ থাকে। উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে বারবার বিষয়টি জানানোর পরও সমস্যার সমাধান হয়নি।

নাটোর রেলস্টেশনের মাস্টার অশোক কুমার চক্রবর্তী অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে মালঞ্চি স্টেশনের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মুঠোফোনে বলেন, মূলত জনবলসংকটের কারণে স্টেশনটির এই দুরবস্থা। কয়েকবার স্টেশনটি পুরোদমে চালুর চেষ্টা করা হলেও পরে তা সম্ভব হয়নি। নতুন করে জনবল নিয়োগ শুরু হয়েছে। প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দেওয়া হলে স্টেশনটির সমস্যার সমাধান হবে।