দর্শনার্থীদের নজর কাড়ছে প্রাণহীন ডাইনোসর–অজগর

কক্সবাজারের ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে গাছের সাথে প্যাঁচিয়ে আছে প্রাণহীন বিশাল অজগর। আজ দুপুরে তোলা
ছবি:প্রথম আলো

ঘন জঙ্গলের পাশ দিয়ে চলে গেছে পাকা সড়ক। সড়কের পাশে সবুজ অরণ্যের মাঝে অল্প খোলা জায়গা। সেখানে একটি মরা চম্পাফুলগাছ পেঁচিয়ে আছে বিশাল এক অজগর। অজগরের মাথার ওপরে (মগডালে) বসে আছে দৃষ্টিনন্দন দুটো মদনটেক। প্রথমে নজর পড়লেই যে কেউ ভয় পাবেন। ভয়ংকর অজগরের সামনে দাঁড়ানোর সাহস কার?

একটু দূরে আরেকটি গাছে অসংখ্য বানর, বেজি ও পাখি। মানুষ দেখলেও বানরগুলো অসহায়। পাখিগুলোও উড়ে না। আরেকটি দূরে খোলা জায়গায় আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত ডাইনোসর। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে জেব্রা, সিংহ, বাঘ, হরিণ কত কিছু। কিন্তু কেউ কাউকে বিরক্ত করছে না, বধ হওয়ার ভয়ও নেই কারও মনে।

দর্শনার্থীদের নজর ডাইনোসর আর অজগরের দিকেই। বিশাল আকারের অজগরটি পুরো একটি গাছ পেঁচিয়ে রেখেছে। দর্শনার্থীদের কেউ ভয়ে কাছে যেতে চান না। তবে কিছুক্ষণ পরেই সাহস নিয়ে অজগর ও ডাইনোসরের পাশে গিয়ে দাঁড়ান, মুঠোফোনে ছবি তোলেন, ধারণ করেন ভিডিও চিত্র। এ চিত্র কক্সবাজার শহর থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের।

২০০১ সালের ১৯ জানুয়ারি ২ হাজার ২৫০ একর বনাঞ্চলে এই সাফারি পার্কটি গড়ে তোলা হয়। পার্কের বিভিন্ন বেষ্টনীতে আবদ্ধ আছে সিংহ, বাঘ, জেব্রা, ওয়াইল্ড বিস্ট, জলহস্তী, ময়ূর, অজগর, কুমির, হাতি, ভালুক, হরিণসহ ৫২ প্রজাতির ৩৪১ প্রাণী। আর উন্মুক্তভাবে আছে ১২৩ প্রজাতির ১ হাজার ৬৫টি প্রাণী। এর মধ্যে গুইসাপ, শজারু, বাগডাশ, মার্বেল ক্যাট, বনরুই উল্লেখযোগ্য। এসব বন্য প্রাণীর পাশাপাশি পার্কের হাঁটাচলার সড়কের পাশে গাছপালায় স্থাপন হয়েছে ইট-পাথরের প্রাণহীন অজগর, ডাইনোসর, বাঘ, সিংহ, জেব্রা, বানর, টিয়াসহ নানা পশুপাখি। দৃষ্টিনন্দন এই প্রাণিকুলের ম্যুরাল দর্শনার্থীদের আলাদা বিনোদন দিচ্ছে।

ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে গেলে দেখা মেলে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত ডাইনোসরের। যদিও সেটা ইট–পাথরের তৈরি
ছবি: প্রথম আলো

ঈদের ছুটিতে সাফারি পার্কে দর্শনার্থীদের ঢল নেমেছে। প্রতিদিন গড়ে পাঁচ হাজার দর্শনার্থী পার্কে আসছেন। বন্য প্রাণীর পাশাপাশি বন্য প্রাণীর ম্যুরাল দেখে উৎফুল্ল তাঁরা। থরে থরে সাজানো ম্যুরালগুলো পার্কের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। দূর থেকে মনে হবে আসল প্রাণী, কিন্তু কাছে গেলেই পরখ করা যায় প্রাণহীন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, পার্ক হাজারো মানুষে ভরপুর। ঢুকতেই প্রথমে নজর পড়ে আকাশছোঁয়া কয়েকটি শতবর্ষী গর্জনগাছের নিচে দাঁড়ানো ডাইনোসর, জেব্রা, বাঘ, সিংহের ম্যুরালে। ফটক পেরিয়ে ঢুকতে হয় আসল পার্কে। ঢুকতেই হাতের বাঁয়ে সরু রাস্তায় চোখে পড়ে অজগর, বানরের বেষ্টনী। পাশে পাখিশালা, সাম্বার ও কুমিরের বেষ্টনী। কুমিরের বেষ্টনীর ওপর জরাজীর্ণ কাঠের সেতু। সেতুর ওপরে দাঁড়িয়ে কুমির দেখছেন দর্শনার্থীরা। সামনে কিছু দূর গেলেই প্রায় ২০০ একরের বনাঞ্চল নিয়ে হাতির বেষ্টনী। পাশে দশতলার একটি ওয়াচ টাওয়ার। আছে চারতলা ও দোতলার আরও দুটি ওয়াচ টাওয়ার। তার পাশেই জলহস্তীর বেষ্টনী।

পার্কের ডান দিকে ৩০ একরের পৃথক দুটি ভালুকের বেষ্টনী। সেখানে ২২টি ভালুক আছে। পূর্ব দিকে জেব্রা বেষ্টনী। জেব্রাগুলো একে অপরের সঙ্গে খুনসুটি করছে। হরিণ বেষ্টনীতে দেখা মেলে সাম্বার, মায়া, চিত্রা হরিণের বিচরণ। বন্য প্রাণীর জীবনচিত্র দেখে আপ্লুত দর্শনার্থীরা। দর্শনার্থীদের বেশির ভাগই শিশু-কিশোর। পরিবারের সঙ্গে তারা প্রাণিকুলের খোঁজখবর নিতে এসেছে। প্রাণীদের এক বেষ্টনী থেকে আরেক বেষ্টনীতে যেতে পথে দেখা মেলে ইট-পাথরে তৈরি প্রাণীদের ম্যুরাল। পায়ে হেঁটে পুরো পার্ক ঘুরতে সময় লাগে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। পার্কে ঘুরতে একটি এসি ও দুটি নন এসি বাসের ব্যবস্থা আছে। বাসে পার্ক ঘুরতে ৪৫ মিনিটের মতো লাগে। এসি বাসে ভাড়া জনপ্রতি ১০০ টাকা আর নন এসি বাসে ১৪ জনের ৪০০ টাকা। পার্কের ৩০ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে পাকা ১৮ কিলোমিটার।

অজগরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন কক্সবাজারের বাজারঘাটা এলাকার ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম। সঙ্গে স্ত্রী–সন্তানসহ পরিবারের ১২ সদস্য। স্কুলপড়ুয়া মেয়ে রাহেলা (১৭) বলে, ‘গাছের সঙ্গে অজগর সাপটি দেখে ভয় পেয়েছিলাম। যখন জানতে পারি, এটি জীবন্ত না, তখন ভয় কেটে গেছে।’ কলেজছাত্র হেলাল উদ্দিন (২০) বললেন, ডাইনোসরটা দারুণ। ডিসকভারি চ্যানেলে প্রায় সময় বিলুপ্ত প্রাণী ডাইনোসর দেখা হয়। আজ বাস্তবে না হলেও ইট-পাথরের ডাইনোসরের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে ভোলেননি।

সাফারি পার্কের গাছে গাছে চেনামুখের ভেলকিবাজি। প্রাণহীন হওয়ায় লাফিয়ে এসে আক্রমণের ভয় নেই
ছবি: প্রথম আলো

সাফারি পার্কে ঢুকতে প্রাপ্তবয়স্কদের ৫০ টাকা, অপ্রাপ্তবয়স্কদের (১৫ বছরের নিচে) ২০ টাকা দিয়ে টিকিট কাটতে হয়। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য ১ থেকে ১০০ জনের দলের জন্য ৫০০ টাকা ও ১০১ থেকে ২৫০ জন পর্যন্ত দলকে গুনতে হয় ৮০০ টাকা। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত পার্ক খোলা থাকে। সপ্তাহে এক দিন মঙ্গলবার বন্ধ থাকে পার্ক।

সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাজহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের ছুটিতে কক্সবাজার ভ্রমণে আসছে ১০ লাখের বেশি পর্যটক। ইতিমধ্যে পাঁচ লাখের বেশি পর্যটকের সমাগম হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক পর্যটক সাফারি পার্ক দেখতে আসছেন। বেষ্টনীতে আবদ্ধ প্রাণিকুলের পাশাপাশি প্রাণহীন ইট-পাথরের ডাইনোসর, অজগর, জেব্রা, বাঘ, সিংহ, হরিণ, বানরসহ নানা প্রজাতির পাখি দেখে মুগ্ধ দর্শনার্থীরা। পার্কের আকর্ষণ বাড়াতে বিভিন্ন স্থানে আরও প্রাণিকুলের ম্যুরাল তৈরির পরিকল্পনা চলছে।

পার্কের ইজারাদার ফজলুল করিম সাঈদী বলেন, করোনা মহামারির কারণে প্রায় দুই বছর বন্ধ ছিল পার্কটি। গত বছরের ২০ আগস্ট পার্কটি খুলে দেওয়া হলেও সেভাবে দর্শনার্থী আসেনি। এবার ঈদের ছুটিতে দর্শনার্থীর আগমন ঘটছে। দৈনিক গড়ে পাঁচ হাজার দর্শনার্থী পার্কে আসছেন, যাঁদের বেশির ভাগই স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী।

ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা, পার্কের নির্জন এলাকায় যৌন হয়রানি ও ছিনতাই রোধে সার্বক্ষণিক পুলিশ মোতায়েন করা আছে। এ পর্যন্ত পার্ক পরিদর্শনে এসে কোনো পর্যটক বা দর্শনার্থীকে সমস্যায় পড়তে হয়নি।