দামের ওঠানামার আতঙ্কে ব্যাপারীরা

এক সপ্তাহ ধানের দাম বাড়তির দিকে থাকলেও এখন আবার কমছে। ৬ দিনে সব জাতের ধান মণপ্রতি কমেছে ৭০ টাকা। ভৈরবের ধানের মোকাম, কিশোরগঞ্জ, ৬ মে
ছবি: প্রথম আলো

১৮ থেকে ২৪ এপ্রিল। ওই সময়ে কিশোরগঞ্জের ভৈরব মোকামে আগের সপ্তাহের বাজারদরের চেয়ে মণপ্রতি ধানের দর বাড়ে ৭০ টাকা। মূল্য বাড়ার এই প্রবণতা থাকে চলতি মাসের ১ তারিখ পর্যন্ত। ২ মে থেকে আবার দর পড়তে থাকে। বর্তমানে প্রতিদিন একটু একটু করে কমছে। আজ শনিবার মোকামে হীরা (মোটা) জাতের ধান বিক্রি হয়েছে প্রতি মণ সর্বোচ্চ ৬৪০ টাকা। বিআর-২৯ ধানের দর গেছে ৭০০ টাকা। অথচ এক সপ্তাহ আগেও একই মোকামে হীরা (মোটা) ধান বিক্রি হয়েছে প্রতি মণ ৭০০ টাকা, আর বিআর-২৯–এর মূল্য ছিল ৭৭০ টাকা।

সপ্তাহে সপ্তাহে দামের এই উত্থান–পতনে বিপাকে আছেন আড়তদারেরা। আতঙ্ক পেয়ে বসেছে ব্যাপারীদের। দাম কমার প্রভাব পড়লেও বাড়ার সুবিধা থেকে বরাবরের মতো এবারও দূরেই থাকছেন কৃষকেরা।

হবিগঞ্জের আজমিরিগঞ্জ থেকে ১ হাজার ৪০০ মণ ধান নিয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে ভৈরব মোকামে এসেছে হেলিম মাঝির ট্রলারটি। দামের পতন ভাব দেখে ২০০ মণ ধান বিক্রি করেই ট্রলার ঘুরিয়ে অন্য কোনো মোকামে যাওয়ার কথা ভাবছেন তিনি।

হেলিম মাঝি বলেন, ‘আমার ট্রলারে কয়েকজন ব্যাপারীর ধান রয়েছে। আজকের বাজারদর জেনে ব্যাপারীরা এই দামে বিক্রি করতে রাজি হচ্ছেন না। কারণ, এই দামে বিক্রি করা হলে বস্তাপ্রতি ৪০ টাকার ক্ষতি হয়ে যাবে। এই জন্য বিকল্প মোকাম খোঁজা হচ্ছে।’

কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, ধানের ভৈরব মোকামের পরিচিতি স্বাধীনতাপূর্ব সময় থেকে। মেঘনা নদীর পাড় ঘেঁষে এই মোকামের অবস্থান। কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও সিলেটের হাওরাঞ্চলের উৎপাদিত ধানের একটি অংশ এই মোকামে কেনাবেচা হয়। হাওরের কৃষি এক ফসলি। ফসল বলতে ধান। ইরি-বোরো প্রধান ফসল। বৈশাখের শুরু থেকে নতুন ধান উঠতে শুরু করে। ফলে তখন ভৈরব মোকামে কেনাবেচা বেড়ে যায় কয়েক গুণ।

এই মোকাম থেকে ধানের ক্রেতা অঞ্চলগুলো হলো ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লালমনিরহাট, চাঁদপুর, মুন্সিগঞ্জ ও কুমিল্লা।

এবার ভৈরব মোকামে নতুন ধানের আমদানি শুরু হয় ২৫ চৈত্র থেকে। পয়লা বৈশাখ থেকে আমদানি বাড়তে থাকে। এখন প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজার হাজার মণ কেনাবেচা হচ্ছে। শুরুতে কেবল বিআর-২৮ ও হীরা ধান এসেছে। তখন বিআর-২৮ বিক্রি হয়েছে ৯৫০ টাকায়। হীরার (মোটা) দর ছিল ৭৫০ টাকা। পরবর্তী সময়ে ওই ধান মণপ্রতি কমে যায় ১০০–১১০ টাকা। এরই মধ্যে সরকার চালের মূল্য নির্ধারণ করে কেনার ঘোষণা দেয়। আতপ চালের মূল্য ধরা হয় প্রতি কেজি ৩৯ টাকা। আর সিদ্ধ চালের মূল্য নির্ধারণ করা ৪০ টাকা। এরপর থেকে ধানের বাজার উঠতে থাকে। মূল্য বাড়ার প্রবণতা থাকে ১ মে পর্যন্ত। এরপর থেকে কমতে শুরু করে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে ভৈরব মোকামে গিয়ে দেখা যায়, বাজারে আমদানির বিপরীতে ক্রেতা নেই। ক্রেতা না থাকায় মোকামে মজুত বাড়ছে। ঘাটে ধানবোঝাই ট্রলারের সংখ্যা কম। বর্তমানে বাজারে বিআর-২৮ ধান নেই। আজ কেবল হীরা আর বিআর-২৯ বিক্রি হচ্ছে।

আ ছাত্তার অ্যান্ড সন্স ভৈরব বাজারের প্রতিষ্ঠিত ধান–চাল ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। ঘাটে ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. মাহাবুবের সঙ্গে কথা হয়।

মাহাবুব বলেন, কিছুদিন দাম ভালো ছিল। এখন আবার কমছে। কমার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ধান–চাল কেনার সরকারি ঘোষণার পর কিছুদিন মিলাররা ধান কিনেছেন। এই কারণে দামটা ওপরের দিকে ছিল। বেশির ভাগ মিলারের কেনা শেষ। ফলে ক্রেতা কমে গেছে। এ ছাড়া কয়েক দিন পর ঈদ। মিল বন্ধ হয়ে যাবে। সেই কারণে বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

মেসার্স হেলাল-জামাল নামে আরেকটি ধান–চালের প্রতিষ্ঠানের মালিক জামাল জানালেন, সামনে যেহেতু ঈদ, সেই কারণে হাওরের কৃষকদের টাকা প্রয়োজন। তাঁরা ধান কাটা বাড়িয়ে দিয়েছেন। একই সঙ্গে বিক্রিও করে ফেলছেন। এই অবস্থায় কৃষকেরা ভালো দাম পাচ্ছেন না।

ভৈরব পৌর শহরের চণ্ডীবের এলাকার এম এম অটো চিড়া মিলের মালিক আ ছাত্তার মিয়া আজ ভৈরব মোকাম থেকে ২০০ মণ ধান কিনেছেন। কম দিয়ে কিনতে পারায় বেশ খুশি তিনি। তবে ছাত্তার জানালেন, এতটা কমে যাবে আশা করেননি। বেশি কমে গেলে কৃষকেরা টিকে থাকতে পারবেন না। তখন বিপদ বড় হবে। সেই কারণে তিনি বাজারে দামের ভারসাম্য রক্ষায় সরকারি উদ্যোগ দাবি করেন।

দাম ওঠার খবর না পেলেও কমার বিষয়টি টের পান বলে দুঃখ প্রকাশ করলেন কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামের বড় হাওরের কৃষক সবুজ মিয়া। তিনি জানালেন, মোকামে দর পড়লে তাঁদের অনেক কথা শোনান ব্যাপারীরা। তবে বেড়ে গেলে তাঁদের একটা টাকাও বেশি দিতে চান না।