দারিদ্র্য জয় করে শত নারীর ভরসা দুলালী

রংপুরের পীরগাছা উপজেলার হাড়িয়াপাড়া গ্রামে হাতপাখা তৈরিতে ব্যস্ত একদল নারী।
ছবি : প্রথম আলো

বাবার অভাব–অনটনের সংসারে বয়স না হতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় দুলালী বেগমকে। ঘরদোরহীন স্বামীর সংসারে এসেও অভাব পিছু ছাড়েনি। এক বেলা খাবার জুটলেও আরেক বেলা খাবার জুটত না। এরই মধ্যে স্বপ্ন দেখেছেন নিজে কিছু করার।

দুলালী শুরু করেন হাতপাখা তৈরির কাজ। নিজে শিখলেন। নিজের ও পাশের গ্রামের নারীদেরও বিনা মূল্যে শেখালেন। পেলেন সাফল্যও। অভাবের সংসারে এল সচ্ছলতা। চার গ্রামের প্রায় পাঁচ শত নারী এখন হাতপাখা তৈরি করে সংসারে এনেছেন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। হাতপাখা তৈরি করে বেশ কাটছে তাঁদের দিন।

দুলালীর বাড়ি রংপুরের পীরগাছা উপজেলার হাড়িয়াপাড়া গ্রামে। উপজেলা সদর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে গ্রামটির বেশির ভাগ বাড়িতে চকচক করছে টিনের চালা। খড়ের কুঁড়েঘর নেই বললেই চলে। গ্রামটির নারীরা ঘরের কাজ সামলাতে সামলাতে, বিশ্রাম নিতে নিতে তৈরি করছেন হাতপাখা। উঠানে ও গাছতলায় জটলা করে চলছে পাখার তৈরির কাজ।

দুলালীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি হাতপাখা তৈরিতে ব্যস্ত। একা নন—স্বামী, ছেলে ও এলাকার কয়েকজন নারী একই কাজ করছেন। এ সময় দুলালী জানান, তাঁর বাবার বাড়ি শরিফ সদর গ্রামে। দশম শ্রেণিতে উঠে ২০০৪ সালে ১৪ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় পাশের হাড়িয়াপাড়া গ্রামের এমদাদুল হকের সঙ্গে। বিয়ের পর স্বামী কর্মহীন ছিলেন। অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। প্রায় অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতে হতো। একদিন তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, দারিদ্র্যের কাছে হার মানবেন না। এই প্রতিজ্ঞা থেকে তিনি ভাবতে থাকেন কিছু একটা করা দরকার। গলার চেইন বিক্রি করে ২০টি হাঁস, ২০টি মুরগি পালন শুরু করেন। এতে কিছু আয় হয়। এক বছরের লাভের টাকায় কেনেন তিনটি ছাগল। তাঁর নতুন জীবনের গল্পটা এখান থেকেই শুরু।

২০০৭ সালে মে মাসে দুলালী তাঁর ফুফু আছমা খাতুনের বাড়ি পীরগাছা উপজেলার নামাপাড়া গ্রামে বেড়াতে যান। সেখানে লক্ষ করেন, ওই গ্রামের নারীরা হাতপাখা তৈরির কাজ করছেন। কাজটি তাঁর মনে ধরে। ফুফুর বাড়িতে পাঁচ দিন থেকে সুইটি বেগম নামের এক নারীর কাছ শিখে নেন হাতপাখা তৈরির সেই কাজ। বাড়ি ফিরে দুলালী তাঁর স্বামীকে পাখা তৈরির উপকরণ সংগ্রহ করতে বললে তিনি এনে দেন। দুই দিনে দুলালী তৈরি করেন ৩০টি পাখা। এ পাখা বিক্রি করে আয় হয় ৬০০ টাকা। খুলে যায় দুলালীর চোখ। স্বামী–স্ত্রী লেগে পড়েন পাখা তৈরির কাজে। ভালো মুনাফা হয়। বদলাতে থাকে সংসারের মলিন চেহারা। তাঁর উন্নতি দেখে প্রতিবেশী অন্য নারীরা পাখা তৈরির কৌশল শিখতে আসেন। দুলালী তাঁদের শিখিয়ে দেন। পাঁচ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে পাখা তৈরি ও বিক্রির ব্যবসা শুরু করে দুলালী এখন ছাদ পেটানো দালানবাড়ি, এক একর আবাদি জমির মালিক। হাঁস-মুরগি ও গাভি পালন করছেন। তাঁর এক ছেলে শুভ রহমান এবার এসএসসি পাস করেছে। মেয়ে ইভা খাতুন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। গাছপালায় ঘেরা বাড়িতে দুই সন্তান নিয়ে সুখের সংসার তাঁর।

হাতপাখা হাতে নিজের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রংপুরের পীরগাছা উপজেলার হাড়িয়াপাড়া গ্রামের দুলালী বেগম।
ছবি: প্রথম আলো

দুলালীর শাশুড়ি ছকিনা বেগম বলেন, ‘মোর বেটার বউটা ভাগ্যবতী। অয় খালি হামারে সংসারের চাকা ঘুরায় নাই, গ্রামের অন্য মানুষেরও সংসারের চাকা ঘুরি দিচে। ’

ওই গ্রামের মোমেদা বেগমের ভিটামাটি ছাড়া কিছুই ছিল না। এখন টিনের বাড়ি, ৩৩ শতক নিজের জমি আছে। গাছগাছালি ঘেরা বাড়িতে হাঁস, মুরগি, গাভি, ছাগল পালন ও পাখা তৈরি করে মাসে ১০ হাজার টাকা আয় করছেন।

স্বামীহারা ওই গ্রামের সহিদা বেগমের অভাব-অনটনের সংসারে আয়ের পথ খুলে দিয়েছে হাতপাখা তৈরির কাজ। পাঁচ-ছয় বছর ধরে হাতপাখা তৈরির কাজ করছেন তিনি। এ আয়ের টাকায় ২০ শতক জমি, টিনের ঘর করেছেন। মাছ চাষের জন্য খনন করেছেন পুকুর। ছয়টি ছাগল, দুটি গাভিও পালন করছেন। সব মিলে এখন তার মাসে আয় ১৪ হাজার টাকা।

রোজ ঘুম থেকে উঠেই এখন আর খাবারের চিন্তায় অস্থির হতে হয় না মনোয়ারা বেগমকে। তাঁর বাড়িতে এখন টিনের ঘর আছে, আছে নলকূপ ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা। ছেলেমেয়েরা স্কুল পড়ছে। চারটি গাভি, পাঁচটি ছাগল ও ২০ শতক জমি কিনেছেন। পাখা তৈরিতে মাসে ১২ হাজার টাকা আয় হচ্ছে তাঁর।

সুলতানা খাতুনের স্বামী দিন-রাত জুয়া খেলায় মেতে থাকতেন। সংসারে অভাব–অনাটনের কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া লেগেই থাকত। চার বছর আগে তিনি হাতপাখা তৈরি শুরু করেন। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ১৩ শতক জমি কিনেছেন, বাড়িতে তুলেছেন টিনের ঘর। স্বামী মোন্নাফ হোসেন জুয়া ছেড়ে এখন করেন পাখা বিক্রয়ের ব্যবসা।

আয়েশা খাতুনের বিয়ে হয় ১৪ বছর বয়সে। আগে ভুমিহীন স্বামীর আয়ে সংসার চলত না। চার সন্তানকে নিয়ে প্রায় উপোষ থাকতে হতো। এখন পাখা তৈরির আয়ের টাকায় সংসার চলছে, স্বামীর আয় জমা থাকছে। ২১ শতক জমি কিনেছে, খড়ে ঘরের জায়াগায় তুলেছে টিনের ঘর, আছে হাঁস-মুরগি, গাভি-ছাগল।

গৃহীনি মর্জিনা খাতুন জানান, হাতপাখা তৈরির কাজে বেশি শ্রম দিতে হয় না। সময় বেশি লাগে না। কাজের ফাঁকে ফাঁকে এটা করা যায়। পাখা বানানোর আগে ১২ মাসেই তাঁদের সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকত। এখন তিনবেলা খাবার জুটছে। একইভাবে গ্রামের রহিমা বেগম, নয়ন তারা, রোমানা খাতুন, মেরিনা বেগমসহ অন্যরা তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির বিবরণ তুলে ধরেন।

পাখা তৈরির কারিগর সাবিয়া বেগম বলেন, ‘পাখা হামার কপাল খুলি দিছে। একনা পাখা বানাতে খরচ হয় ৬-৭ টাকা আর পাইকারি বিক্রি হয় ২০-২২ টাকা। চৈত্র থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত পাখার বেচাকেনা ভালো হয়।’ একজন দিনে ২০টি পর্যন্ত পাখা তৈরি করতে পারেন।

পাখা তৈরির আরেক কারিগর লতা বেগম বলেন, ফুল পাখা, করমোর পাখা, শাল গাঁথুনী, ধারই গাঁথুনী, বিস্কুট গাঁথুনী, পানাষী গাঁথুনীসহ নানান রঙের পাখা তৈরি করা হয়। পাখা তৈরির প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির পরিত্যক্ত বিভিন্ন প্রকার রঙিন সুতা। ঢাকা, সান্তাহার, বগুড়াসহ বিভিন্ন জেলা থেকে ১৩০ টাকা কেজি দরে এ সুতা কিনে আনা হয়। এরপর সেগুলো বাড়িতে নিয়ে এসে ভালোভাবে গুছিয়ে পাখা তৈরির জন্য প্রস্তুত করা হয়। বাঁশের চিকন (বাতার) গোলাকার একটি ফ্রেমে লোহার শলাকার সাহায্যে সুতা দিয়ে ফ্রেমের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত সুতা বুননের মাধ্যমে তৈরি করা হয় এই নজরকাড়া রঙিন পাখা। প্রতি কেজি সুতা দিয়ে ৩০টি পাখ তৈরি করা যায়। একটি পাখা অন্তত ২০-২২ টাকা বিক্রি হয়। এতে খরচ বাদে প্রতিটি পাখায় ১৪-১৫ টাকা লাভ হয়। পাইকারেরা গ্রামে এসে এ পাখা কিনে নিয়ে যায়। অনেকে বাস-ট্রেনে ফেরি করে খুচরা মূল্যে প্রতি পাখা ৩০-৩৫ টাকা বিক্রি করে।

ওই গ্রামের বাসিন্দা ইটাকুমারী ইউনিয়নের সদস্য হাবিবুর রহমান বলেন, আগে ওই গ্রামের মানুষের কষ্টের শেষ ছিল না। তারা রিলিফের জন্য ইউপিতে ধরনা দিত। অভাব-অনাটনে লোকজন ঝগড়াবিবাদে মেতে থাকত। গ্রামের নারীরাও তাঁদের স্বামীর হাতে নানা রকম নির্যাতনের শিকার হতেন। কিন্তু এখন গ্রামটির চিত্র বদলে গেছে। পাখা তৈরি করে এ গ্রামসহ ফকিরপাড়া, কালিয়াপাড়া গ্রামের চার শতাধিক নারী রোজগার করায় তাঁরা পরিবারের সবার কাছে ভালোবাসা পাচ্ছেন।

ইটাকুমারী ইউপি চেয়ারম্যান আবুল বাসার বলেন, দুলালীর মতো আত্মনির্ভরশীল নারী সমাজে এখন খুবই প্রয়োজন। তাঁর হাত ধরে গ্রামের নারী তাঁদের জীবনমানের উন্নতি করতে পেরেছেন।