দিনাজপুর: মাইন বিস্ফোরণের মর্মান্তিক ঘটনা পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্তির দাবি

দিনাজপুরের মহারাজা হাইস্কুল মাঠে মাইন বিস্ফোরনে নিহত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা সংবলিত স্মৃতিফলক। বুধবার সকালে চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণে
ছবি: প্রথম আলো

দিনাজপুর শক্রমুক্ত হয় ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারাসহ সাধারণ মানুষ। আতঙ্ক থেকে বেরিয়ে বুকভরা স্বস্তির নিশ্বাস নিতে শুরু করেছে সবাই। কিন্তু ২৩ দিন পরে দিনাজপুরে বড় ধরনের দুর্ঘটনা পুরো দেশকে শোকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। দিনাজপুর শহরের মহারাজা হাইস্কুল মাঠে মাইন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। মুহূর্তে ধুলা আর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন দিনাজপুর। বিকট শব্দে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে মানুষ।

১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি মহারাজা হাইস্কুলের মাছে ওই মাইন বিস্ফোরণের ঘটনায় শহীদ হন কয়েক শ বীর মুক্তিযোদ্ধা। আহত হন শতাধিক। এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিহত শহীদদের স্মরণে ৬ জানুয়ারিকে মহারাজা হাইস্কুল মাইন বিস্ফোরণের ট্র্যাজেডি দিবস হিসেবে পালন করে আসছে দিনাজপুরের মানুষ।

এই দিবস উপলক্ষে বুধবার সকাল নয়টায় শহরের চেহেলগাজী শহীদ বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হয়। পরে ৬ জানুয়ারি স্মৃতি পরিষদের উদ্যোগে প্রেসক্লাব মিলনায়তনে আলোচনা সভা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন স্মৃতি পরিষদের সভাপতি সফিকুল হক। আলোচনায় অংশ নেন সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) দিনাজপুর জেলা সভাপতি জলিল আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক সুলতান কামালউদ্দিন, প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়ক আজহারুল আজাদ প্রমুখ।

১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাম্পে অবস্থান করছিলেন ছয় শতাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধা। ওই দিন মাইন বিস্ফোরণের ঘটনায় উপস্থিত বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ পাশের কুমারপাড়া এলাকার অনেকেই প্রাণ হারান। আহত হন শতাধিক। ঘটনাস্থলে প্রায় ২০-২৫ ফুট গভীর গর্ত হয়।

সভায় বক্তারা বলেন, স্বাধীনতাযুদ্ধের পরে একসঙ্গে এতজন বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রাণহানি কোথাও ঘটেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে আজ অনেকেই বাণিজ্য করছেন। কিন্তু শহীদদের কেউ স্মরণ করছেন না। ওই ঘটনায় নিহত ব্যক্তিরা স্বাধীনতার সুফল পাননি। অনেকে স্ত্রী ও সন্তানের মুখও দেখতে পারেননি। বক্তারা দিনটিকে জাতীয়ভাবে স্মরণ করাসহ এই বিয়োগান্তক ঘটনা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার, স্মৃতিসৌধ নির্মাণ ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় হতাহত ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশের দাবি জানান।

ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা জানান, ১৪ ডিসেম্বরের পরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হামজাপুর, তরঙ্গপুর, পতিরাম, বাঙ্গালবাড়িসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধারা জড়ো হতে থাকেন মহারাজা হাইস্কুল মাঠ ট্রানজিট ক্যাম্পে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যদের ফেলে যাওয়া, লুকিয়ে রাখা, পুঁতে রাখা মাইন, গোলাবারুদসহ অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করে তাঁরা এখানে জড়ো করছিলেন।
১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি বিকেলে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট ও নবাবগঞ্জ উপজেলা থেকে উদ্ধার করা বেশকিছু মাইন একটি ট্রাকে উঠিয়ে ক্যাম্পে এনে নামিয়ে রাখছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। এ সময় অসাবধানতাবশত মাইনের বিস্ফোরণ ঘটে।

ওই সময় ক্যাম্পে অবস্থান করছিলেন ছয় শতাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধা। ওই দিন মাইন বিস্ফোরণের ঘটনায় উপস্থিত বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ পাশের কুমারপাড়া এলাকার অনেকেই প্রাণ হারান। আহত হন শতাধিক। ঘটনাস্থলে প্রায় ২০-২৫ ফুট গভীর গর্ত হয়। পরদিন দিনাজপুর গোর-এ-শহীদ ময়দানে শহীদদের জানাজা হয়। সামরিক মর্যাদায় চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণে তাঁদের দাফন করা হয়। এ ঘটনার পর স্কুল প্রাঙ্গণে ১২০ জন এবং চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণে ১৭৭ জনের নাম উল্লেখ করে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে।