দুর্নীতি–অবহেলার বলি ৩৪ জন

  • অভিযুক্তদের মধ্যে তিতাসের ৮ জন, ডিপিডিসির ২ ও মসজিদ কমিটির ২৬ জন রয়েছেন।

  • তিতাসের আটজন কর্মী গ্রেপ্তারের পর জামিনে বেরিয়ে স্বপদে বহাল।

  • মসজিদ কমিটির পাঁচজন ওই বিস্ফোরণে নিহত হন।

নারায়ণগঞ্জের তল্লায় মসজিদে বিস্ফোরণের পরদিনের চিত্র
ফাইল ছবি
তিতাস, ডিপিডিসি ও মসজিদ পরিচালনা কমিটির ৩৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করেছে সিআইডি।

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা এলাকাটি বেশ ঘনবসতিপূর্ণ। এ এলাকায় অবৈধ গ্যাসলাইনের বিষয়টিও অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেট’। স্থানীয় বায়তুস সালাত জামে মসজিদের পাশে থাকা গ্যাসের লাইনগুলোর মধ্যে মোটে দুটি বৈধ আর অনেকগুলো অবৈধ। তিতাস গ্যাসের দেওয়া এ রকম একটি অবৈধ গ্যাসলাইনের ওপর মসজিদ কমিটি জেনেশুনেই বারান্দার ঢালাই দেয়। এতে গ্যাসের পাইপ ফেটে ছিদ্র হয়। ফলে ফাটা লাইন থেকে গ্যাস নিঃসরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ত। ওই মসজিদের মুসল্লিরা প্রায়ই গ্যাসের গন্ধ পেতেন। জানানো হলেও মেরামতের সঙ্গে যুক্ত তিতাসের কর্মীরা আর তা মেরামত করেননি।

গত ৪ সেপ্টেম্বরও ওই মসজিদের ভেতরে গ্যাস জমা হয়ে ছিল। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসি) মসজিদটিতে নামাজের সময় দরজা, জানালা লাগিয়ে সব এসি চালু করে দেওয়া হয়। এ সময়ই হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলে মসজিদের অবৈধ বিদ্যুৎ লাইন চালু করতে কাটআউট যুক্ত করার সময় বৈদ্যুতিক সুইচে স্ফুলিঙ্গ (স্পার্ক) হয়। স্ফুলিঙ্গ পেয়ে বিকট শব্দে গ্যাস বিস্ফোরণ হয় এবং আগুন ধরে যায়। এতে ভেতরে থাকা ৩৭ জনের মধ্যে ৩৪ জন পুড়ে মারা যান।

পশ্চিম তল্লার ওই মসজিদে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে করা মামলাটি তদন্তের পর দুর্নীতি আর অবহেলার এমন গল্পই শুনিয়েছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তারা। এতগুলো মানুষের মৃত্যুর জন্য সিআইডি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির (ডিপিডিসি) কর্মকর্তা ও মসজিদ পরিচালনা কমিটির সদস্যদের লোভ ও অবহেলাকেই দায়ী করেছে। তবে তিতাস অবশ্য তার কর্মীদের দোষ দেখছে না।

মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত ডিআইজি-ঢাকা বিভাগ) মো. ইমাম হোসেন ১৭ অক্টোবর প্রথম আলোকে বলেন, মামলাটির তদন্ত শেষ পর্যায়ে। অবহেলায় মৃত্যুর অভিযোগে তিতাস, ডিপিডিসি ও মসজিদ পরিচালনা কমিটির মোট ৩৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র চূড়ান্ত হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে আদালতে এ মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।

মসজিদের দুটি বিদ্যুতের লাইনের মধ্যে একটি অবৈধ। ঘুষ নিয়ে মিটার রিডার আরিফুর ও মিস্ত্রি মোবারক ওই অবৈধ বিদ্যুৎ–সংযোগটি দেন।
মামলা তত্ত্বাবধান ও তদন্ত তদারকের যুক্ত সিআইডির কর্মকর্তা

সিআইডি সূত্র জানিয়েছে, ৩৬ জনের মধ্যে তিতাসের আটজন, ডিপিডিসির দুজন ও মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতিসহ ২৬ সদস্য রয়েছেন। এর মধ্যে তিতাস গ্যাসের ফতুল্লা অঞ্চলের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম, উপব্যবস্থাপক মাহমুদুর রহমান, সহকারী প্রকৌশলী সহকারী এস এম হাসান শাহরিয়ার, সহকারী প্রকৌশলী মানিক মিয়া, কর্মী মো. ইসমাইল প্রধান, সাহায্যকারী হানিফ মিয়া, সিনিয়র উন্নয়নকারী আইউব আলী ও সিনিয়র সুপারভাইজার মনিবুর রহমান চৌধুরী এবং অভিযোগপত্রে ডিপিডিসি নারায়ণগঞ্জ পূর্ব অঞ্চলের মিটার রিডার আরিফুর রহমান ও বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি মোবারক হোসেন রয়েছেন।

তাঁদের মধ্যে তিতাসের আটজন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ডিপিডিসির দুজন গ্রেপ্তার হন। তাঁদের মধ্যে বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি মোবারক হোসেন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তিতাসের আটজন কর্মকর্তা-কর্মচারী জামিনে বেরিয়ে গেছেন। আর আগুনে পুড়ে মসজিদে পাঁচজনের মৃত্যু হওয়ায় তাঁদের অভিযোগপত্র থেকে অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে।

মামলা তত্ত্বাবধান ও তদন্ত তদারকের সঙ্গে যুক্ত সিআইডির একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত ও গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের জবানবন্দিতে অবৈধ গ্যাসলাইনগুলোর বিষয়ে অনেক কিছু জানা গেছে। আর মসজিদের দুটি বিদ্যুতের লাইনের মধ্যে একটি আবার অবৈধ। ৪০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে মিটার রিডার আরিফুর রহমান ও মিস্ত্রি মোবারক হোসেন ওই অবৈধ বিদ্যুৎ–সংযোগটি দেন।

অবহেলায় মৃত্যুর অভিযোগে তিতাস, ডিপিডিসি ও মসজিদ পরিচালনা কমিটির মোট ৩৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র চূড়ান্ত হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে আদালতে এ মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।
মো. ইমাম হোসেন, সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি

মসজিদ কমিটির ধর্মবিষয়ক সম্পাদক মো. আল আমিন গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ওই এলাকার গ্যাসলাইনে যে ছিদ্র রয়েছে, সে সন্দেহ অনেকেই করতেন। তবে যে জায়গায় পাঁচ-ছয়টি ছিদ্র আছে বলে বলা হতো, সেখান থেকে মসজিদের বারান্দা দূরে। মসজিদে ঢোকার যে একটি সিঁড়ি করা হয়েছে, সেটি ছিদ্র থাকা গ্যাসলাইনের কাছে, তবে ওপরে নয়। এ সিঁড়িও এখানে করা উচিত হয়নি বলে মনে করেন তিনি। তাঁর দাবি, মসজিদ কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ পাঁচজন মসজিদে এ অবৈধ বিদ্যুৎ–সংযোগ দিয়েছেন। কমিটির বাকি ২৬ সদস্যের সঙ্গে তাঁরা এ বিষয়ে আলোচনাও করেননি। এই লোকগুলো মসজিদ তৈরি করেছেন, শুরু থেকেই তাঁরা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন।

দোষ দেখছে না তিতাস

গত ১৭ সেপ্টেম্বর তিতাস গ্যাস, ফায়ার সার্ভিস ও নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসন গঠিত পৃথক তদন্ত কমিটিরও তদন্ত প্রতিবেদনেও বলা হয়, গ্যাস–সংযোগের অবৈধ পাইপলাইনের ওপর মসজিদ নির্মাণ করায় লাইনের ছিদ্র থেকে নির্গত গ্যাস মসজিদে জমা হয়। বিদ্যুতের অবৈধ লাইন ব্যবহার করতে গিয়ে স্পার্কের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটে মসজিদে আগুন ধরে। পরে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট আটজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করে। এর আগে ৭ সেপ্টেম্বর তিতাস তাদের আট কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়।

এখন তিতাস তার কর্মীদের দোষ দেখছে না। গ্রেপ্তার হওয়া আটজনই জামিনে মুক্ত হয়ে আবার স্বপদে বহাল হয়েছেন। তবে তাঁদের নারায়ণগঞ্জ থেকে সরিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বদলি করা হয়েছে।

সেই নোটিশে বলা হয়, ‘বায়তুস সালাত জামে মসজিদের অভ্যন্তরে জমে থাকা গ্যাসে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এতে অদ্যাবধি ২৭ জন মুসল্লি মৃত্যুবরণ করেন এবং আরও ১০ জন সংকটাপন্ন রয়েছেন। যার কারণে অত্র কোম্পানির ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। ঘটনাস্থল আপনার কর্মস্থলের আওতাধীন, সে ক্ষেত্রে আপনার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে আপনি ব্যর্থ হয়েছেন।’

তবে এখন তিতাস তার কর্মীদের দোষ দেখছে না। গ্রেপ্তার হওয়া আটজনই জামিনে মুক্ত হয়ে আবার স্বপদে বহাল হয়েছেন। তবে তাঁদের নারায়ণগঞ্জ থেকে সরিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বদলি করা হয়েছে।

তিতাসের ফতুল্লা অঞ্চলের তখনকার উপমহাব্যবস্থাপক মফিজুল ইসলাম বর্তমানে ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত আছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় তিতাসের আটজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করে তিতাসের ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে তাঁদের সংযুক্ত করা হয়েছিল। তিতাসের পৃথক দুই কমিটির প্রতিবেদনে তাঁরা নির্দোষ প্রমাণিত হন। পরে তাঁদের তিতাসের বিভিন্ন আঞ্চলিক কার্যালয়ে পদায়ন করা হয়। তবে সিআইডির তদন্তে তিতাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হলে এবং অভিযোগপত্র দিলে এ ব্যাপারে তার কিছু বলার নেই।

ডিপিডিসির কিছু বলার নেই

মসজিদে অবৈধ বিদ্যুৎ–সংযোগে ডিপিডিসি দায় এড়াতে পারে কি না, জানতে চাওয়া হয়েছিল সংস্থাটির নারায়ণগঞ্জ পূর্বাঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম মোর্শেদের কাছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যদিও আরিফুর ডিপিডিসির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মিটার রিডার, তবে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগে যুক্ত থাকায় তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে আর মোবারক স্থানীয় বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি। মোবারক হোসেন ও আরিফুর রহমানের বিরুদ্ধে অপরাধ পেলে সিআইডি ব্যবস্থা নেবে। এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই।’