পাহাড়ি ঢলে আগাম বন্যা
দুর্ভোগ যেন পিছুই ছাড়ছে না সুনামগঞ্জের চাষিদের
ভারী বৃষ্টি ও উজানের ঢলে সৃষ্ট বন্যায় বিপাকে পড়েছেন হাওরের চাষিরা। অনেক কৃষকেরই ফসল তলিয়ে গেছে।
সুনামগঞ্জে এবার এমনিতেই এপ্রিলের প্রথম দিকে নামা উজানের পাহাড়ি ঢলে কিছু হাওরে ফসলহানি ঘটেছে। এখন আবার ভারী বৃষ্টি ও উজানের ঢলে সৃষ্ট বন্যায় বিপাকে পড়েছেন হাওরের চাষিরা। বন্যার পানিতে হাওরের উঁচু অংশে থাকা অনেক কৃষকের ফসলই তলিয়ে গেছে।
টানা বৃষ্টিতে ধান মাড়াই ও শুকানো নিয়ে দুর্ভোগে আছেন চাষিরা। শুকাতে না পারায় স্তূপ করে রাখায় অনেকের ধান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চারদিকে বন্যার পানি থাকায় ধান শুকানোর জায়গারও সংকট দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় গ্রামের পাশের সড়কই ভরসা। চাষিরা সুযোগ পেলেই বাড়ি থেকে ধান এনে সড়কে মাড়াই ও শুকোনোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু বৃষ্টিতে সেটিও ঠিকমতো করতে পারছেন না তাঁরা।
গতকাল বুধবার দুপুরে সুনামগঞ্জে কিছু সময় রোদ ছিল। এ সময় জেলা শহর থেকে জামালগঞ্জ উপজেলার সাচনাবাজার সড়ক ধরে যাওয়ার সময় পুরো সড়কের ওপরই মানুষকে ধান শুকানো, মাড়াই, পরিষ্কার করা, খড় শুকানোর কাজ করতে দেখা গেছে। পরিবারের নারী-শিশুরাও যোগ দিয়েছে এ কাজে। অনেকেই হাওরের পানিতে ডুবে যাওয়া ধান তুলে এনে সড়কের পাশে রাখছিলেন। আবার কেউ কেউ ধান মাড়াই করছিলেন। নারীরা সড়কের ওপর ধান শুকানোতে ব্যস্ত ছিলেন।
বড়ঘাট এলাকায় দেখা যায়, কলেজছাত্র সারোয়ার হোসেন তাঁর বড় ভাই জাহিদুল ইসলামকে নিয়ে একটি নৌকায় করে হাওর থেকে কাটা ধান এনে সড়কের ধারে রাখছেন। এসব ধান ভেজা। জাহিদুল বলেন, চার দিন আগে যখন পাহাড়ি ঢলে জমি তলিয়ে যাচ্ছিল, তখন এগুলো কাটা। এরপর পানিতে তলিয়ে যায়। বৃষ্টিতে ধান আনা সম্ভব হয়নি। গতকাল দুপুরে বৃষ্টি না হওয়ায় দুই ভাই মিলে বুকসমান পানি থেকে সেই ধান তুলে আনছেন।
সারোয়ার হোসেন জানান, তাঁরা এবার এলাকার করচার হাওরে ছয় একর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করেছিলেন। বন্যায় এক একর জমির ধান তলিয়ে গেছে। দুই একর জমির ধান কাটা হলেও বৃষ্টিতে মাড়াই ও শুকানোর কাজ করতে পারছেন না।
একই গ্রামের আরেক কৃষক মিজানুর রহমান বলেন, ‘ধান মাড়াই করি পাঁচ দিন ধরি শুকাতে পারছি না। ঘরেই ধান নষ্ট হচ্ছে।’
ধান শুকানোতে ব্যস্ত থাকা জাবেদা বেগম বলেন, ‘ধান তো ঘরও থাকতে থাকতে নষ্ট অইযায়। আমরা বড় দুর্ভোগও পড়ছি।’
টুকগাও গ্রামের পাশে গিয়ে দেখা যায়, সড়কের ওপরে প্রাথমিক বিদ্যালয়পড়ুয়া দুই সন্তান শিহাব ও শাকিলাকে নিয়ে ধান বাতাসে উড়িয়ে পরিষ্কার করছেন কৃষক সেলিম মিয়া। তিনি বলেন, ‘বাড়িতে পাঁচ দিন ধরে ধান রাখা। সবখানে পানি। একটু রইদ উঠায় ধান সড়কে নিয়া আইছি।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জে এবার ছোট–বড় ১৩৭টি হাওরে ২ লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছিল। এপ্রিল মাসের পাহাড়ি ঢলে ২০টি ছোট–বড় হাওরে প্রায় ৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাওরের ভেতরের ধান কাটা শেষ। এখন হাওরের উঁচু অংশের সাড়ে ৯ হাজার হেক্টর জমির ধান কাটা বাকি আছে। এগুলো কাটতে আরও ১৫ দিন সময় লাগবে। বন্যায় ৭২০ হেক্টর জমির ধান নিমজ্জিত হয়েছে। এ ছাড়া বাদাম ৭০ হেক্টর, আউশ ধানের বীজতলা ৪৮ হেক্টর এবং ৪০ হেক্টর জমির সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, টানা বৃষ্টির কারণেই মানুষ ধান মাড়াই ও শুকানো নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। বাড়িতে স্তূপ করে এক সপ্তাহের বেশি সময় ভেজা ধান থাকলে সেগুলো নষ্ট হয়ে যেতে পারে। পানি দ্রুত নেমে গেলে নিমজ্জিত ধান নষ্ট হবে না।