দুর্যোগ এলেই নির্ঘুম রাত

ঘূর্ণিঝড় সিডরের ১৪ বছরেও উঁচু বাঁধ নির্মাণ হয়নি। গ্রামে নেই আশ্রয়কেন্দ্র। বন্যা–জ্বলোচ্ছাসে চরম ঝুঁকিতে থাকে স্থানীয় ব্যক্তিরা।

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে উচ্চ জোয়ারে পানি উঠেছে রেমিজা বেগমের বাড়ির উঠানে। গত বৃহস্পতিবার পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ মির্জাগঞ্জ গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

গৃহবধু রেমিজা বেগম (৪৫) ১৫ বছর ধরে পায়রা নদীর পারে বসবাস করছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা জোয়ারের পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেলেই প্লাবিত হয় তাঁর বসতঘরটি। নদীর তীরে উঁচু বাঁধ না থাকায় জোয়ারের আঘাতে ঘরের মালামালও ভেসে যায়। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসেও বাঁধ উপচে পানি ঢোকে লোকালয়ে। এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় শিশুসন্তানদের নিয়ে উঁচু স্থানে অথবা অন্যের বাড়ি আশ্রয় নিতে হয়।

পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ মির্জাগঞ্জ গ্রামের বাসিন্দা রেমিজা বেগম বলেন, ঝড়-বন্যার আভাস পেলেই তাঁদের আতঙ্কে থাকতে হয়। ঘূর্ণিঝড় সিডরের দীর্ঘ ১৪ বছরেও এলাকায় উঁচু বাঁধ নির্মাণ হয়নি। গ্রামে নেই আশ্রয়কেন্দ্র। এখনো তাদের জীবন ও সম্পদ অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।

২০০৭ সালে সিডরে মির্জাগঞ্জ উপজেলায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। বাঁধ বিধ্বস্ত হয়ে প্লাবিত হয় নদীপারের এলাকা। ভেসে যায় বাড়িঘর, গবাদিপশু। ওই সময়ে মারা গিয়েছিল ১১৫ জন। নিহত ব্যক্তিদের একজন রেমিজার তিন বছরের শিশুকন্যা তানজিলা। সিডরের সময় প্রবল জলোচ্ছ্বাসে তানজিলাকে কোল থেকে কেড়ে নিয়ে যায়। ১১ দিন পর প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে ভাঙা গাছের ডালের সঙ্গে মৃত তানজিলাকে পাওয়া যায়। সেই কথা আজও ভুলতে পারেননি রেমিজা।

দিনমজুর স্বামী নুরুল হক, এক ছেলে তানভীর (১১), দুই মেয়ে সুমাইয়া (১০) ও সুরাইয়াকে (৫) নিয়ে এখন পাঁচজনের সংসার রেমিজার। সিডরের দিনের বর্ণনা দিয়ে রেমিজা বেগম বলেন, ‘সিডরের কথা মনে হইলে এহনও বুকের মধ্যে ব্যাথা দগদগ করে। একমাত্র মাইয়া তানজিলারে বুকে লইয়া ঘরেই ছিলাম। কিন্তু বাতাসে ঘরের টিন উড়াইয়া লইয়া গেছে। হের পরই নদীর পানি হু হু কইরা আইয়া ঘর তলাইয়া যাইতে থাকে। আমি মাইয়াডারে বুকে লইয়া ঘর থেইক্যা বাইরাইয়া উঁচু জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করি। গাছ ধইরা বাঁচার চেষ্টার করতে করতে কোল থেকেও মাইয়াডা হারাইয়া যায়।’ বলেত বলতে কেঁদে ফেলেন তিনি।

রেমিজা বেগমের মতো অনেকেই সিডরসহ দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার কথা বলেন। এর মধ্যে ওই গ্রামের মোসলেম হাওলাদারের দুই বছরের মেয়ে মারিয়াও জলোচ্ছ্বাসে মারা গিয়েছিল। তিনি বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলেই তাঁরা জলোচ্ছ্বাসের আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়। পায়রা নদীর পানি বাড়লেই প্লাবিত হয় মির্জাগঞ্জ গ্রামের নদীপারের গ্রামগুলো।

মির্জাগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. মনিরুল ইসলাম লিটন সিকদার বলেন, ইউনিয়নের মির্জাগঞ্জ গ্রামসহ পিঁপড়াখালী, ভাজনাকদমতলা, সুন্দ্রা, আন্দুয়া গ্রামে কোনো সাইক্লোন শেল্টার নেই। এসব এলাকার নড়বড়ে বেড়িবাঁধ দিয়ে সহজেই জোয়ারের পানি প্রবেশ করে এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। বন্যা বা জলোচ্ছ্বাসে এসব এলাকার বাসিন্দারা চরম ঝুঁকিতে থাকে। তাঁরা পাঁচ বছর মেয়াদে বহুবার মন্ত্রণালয়ে সাইক্লোন শেল্টারের চাহিদা দিয়েছেন। কিন্তু কাজ হয়নি।

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে মির্জাগঞ্জের পায়রা নদীর পানি ৪ থেকে ৫ ফুট বৃদ্ধি পেয়ে উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের ৬০ বর্গকিলোমিটার গ্রামাঞ্চল প্লাবিত হয়। জলোচ্ছ্বাসের পানি বাঁধ উপচে নদীর পারের লোকালয় প্লাবিত হয়ে বাড়িঘরের মালামাল ভেসে গিয়েছে। কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোসা. তানিয়া ফেরদৌস প্রথম আলোকে বলেন, পায়রা নদীপারের প্রতিটি গ্রামে যাতে অত্যন্ত একটি করে সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা হয়, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) পটুয়াখালীর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হালিম সালেহী বলেন, জলোচ্ছ্বাসের আঘাতে পায়রাপারের মির্জাগঞ্জ গ্রামসহ বিভিন্ন অংশে তিন কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা জলোচ্ছ্বাসে পায়রাপাড়ের বাঁধ ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়। তবে পায়রাপারের মানুষের জীবন ও সম্পদ নিরাপত্তার জন্য মেগা প্রকল্প নিয়ে স্থায়ী সমাধান দরকার।