
অক্লান্ত পরিশ্রম, সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবসায়িক সততায় সফলতা পেয়েছেন বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার ময়ূর কাশিমালা গ্রামের বেলাল হোসেন সরদার। মাছ চাষে অভাবনীয় এ সাফল্যের জন্য এ বছর ব্যক্তিপর্যায়ে জাতীয় শ্রেষ্ঠ মৎস্য চাষির পুরস্কার পেয়েছেন। পাশাপাশি অনেক বেকার মানুষের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করেছেন তিনি।
বেলাল হোসেনের বাবা সখের আলী ছিলেন একজন দরিদ্র কৃষক। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে সখের আলী নদী থেকে ডিম পোনা এনে মাছ চাষ শুরু করেন। বাবার ব্যবসায় সাহায্য করতে একপর্যায়ে তিনি হ্যাচারি তৈরির উদ্যোগ নেন। অনেক কষ্টে টাকা জোগাড় করে ১৯৯১ সালে ছোট আকারে একটি মাছের হ্যাচারি তৈরি করেন। মাত্র ছয় হাজার টাকা পুঁজি ও দুটি পুকুর নিয়ে শুরু হয় মাছ চাষ। একসময় নিজের দুটি পুকুরে মাছ চাষের পাশাপাশি ইজারা নেন আরও কয়েকটি পুকুর। পরিশ্রম আর সততায় বাড়তে থাকে বেলালের ব্যবসার পরিধি। তাঁর হ্যাচারিগুলোতে দেশি প্রজাতির রুই-কাতলার পাশাপাশি চাষ হচ্ছে সিলভারকার্প, পাঙাশ, গ্রাসকার্প, ব্ল্যাককার্পসহ নানা প্রজাতির মাছ। সম্প্রতি তাঁর হ্যাচারিতে যোগ হয়েছে মনোসেক্স তেলাপিয়া ও থাই কই।
২০০০ সালে তিনি চারটি মৎস্য খামারে চাষাবাদ শুরু করেন। বর্তমানে সেখানে প্রায় ৩০০ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। এ ছাড়া তাঁর মাছের খাবার তৈরির কারখানায় প্রায় ১০০ জন শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন। তাঁর মাছের খামারকে কেন্দ্র করে উপজেলার কয়েক হাজার ভ্রাম্যমাণ মাছ ব্যবসায়ী জীবিকা নির্বাহ করছেন। মাছ চাষের পাশাপাশি বেলাল হোসেন তাঁর প্রতিটি খামারে প্রচুর পরিমাণ ফলদ ও বনজ গাছ রোপণ করেছেন। এসব গাছ দেখাশোনার জন্য রয়েছেন ১৫-২০ জন কর্মচারী। বেলাল হোসেনের রয়েছে দুটি ধানের চাতাল ও নিজস্ব পরিবহনব্যবস্থা।
জাতীয় পুরস্কারের পাশাপাশি তিনি জেলা পর্যায়ে তিনবার ও উপজেলা পর্যায়ে চারবার সেরা মৎস্য চাষির পুরস্কার পেয়েছেন। বর্তমানে বেলাল হোসেন দুটি মৎস্য হ্যাচারি ও মাছের খাদ্য তৈরির কারখানাসহ ১৯০ একর জলাশয়ের মালিক। বর্তমানে তাঁর নিজ গ্রামে দুটিসহ নওগাঁর রানীনগর উপজেলার পারইল ও ঢেকড়া গ্রামে মোট চারটি মাছের প্রকল্প রয়েছে। খামারের মাছের জন্য যে পরিমাণ খাদ্যের প্রয়োজন হয়, তার জোগানও আসে নিজস্ব কারখানা থেকে। তাঁর খামারে উৎপাদিত রেণুপোনা চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, পাবনা, রংপুর, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হচ্ছে।

আদমদীঘি সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রফি আহম্মেদ বলেন, ‘বেলাল হোসেনের সাফল্য এলাকার তরুণদের মাছ চাষে অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁকে অনুসরণ করে এ ইউনিয়নে বর্তমানে ৫০টির বেশি হ্যাচারি গড়ে উঠেছে। এলাকার আরও অনেকেই বেলালের মতো সাফল্য পাবেন বলে আশা করছি।’
বেলাল হোসেন বলেন, মাছের খাদ্যের অতিরিক্ত দাম ও সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ না পাওয়া মৎস্য চাষের মূল অন্তরায়।
বগুড়া জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ক্ষিরোদ কুমার বলেন, বেলাল হোসেন সারা দেশের গর্ব। তিনি মাছ চাষে যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন, তা সবার জন্য অনুকরণীয়। তিনি প্রমাণ করেছেন, পরিশ্রম আর সততার কাছে দারিদ্র্য কোনো প্রতিবন্ধকতা হতে পারে না।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আলী হোসেন শামীম বলেন, বেলাল হোসেনের মৎস্য খামারের হ্যাচারিতে বছরে ৪২ হাজার মেট্রিক টন পাঙাশের রেণু পোনা উৎপন্ন হয়। তা দিয়ে দেশের প্রায় ৮০ ভাগ চাহিদা পূরণ হয়। আর বার্ষিক মৎস্য উৎপাদন হয় নয় হাজার মেট্রিক টন। এর অর্ধেকই দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হয়।
আদমদীঘি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুহুল আমিন বলেন, বেলাল হোসেনের মতো মানুষ আরও সৃষ্টি হলে বাংলাদেশ বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।