দোকানের সঙ্গে স্বপ্ন পুড়ে শেষ

বাবার জমি বিক্রি, নিজের জমানো টাকা আর ঋণ নিয়ে মোট ১০ লাখ টাকা দিয়ে খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানার পাশে দোকান দেন ওমর ফারুক।

পুড়ে যাওয়া দোকানে ওমর ফারুক ও তাঁর দুই কর্মচারী
ছবি: প্রথম আলো

থানা কার্যালয়ের পাশেই দোকান। তাই মনে এতটুকু ভয় ছিল না ওমর ফারুকের। মালামালের পাশাপাশি নগদ টাকাও দোকানে রেখে নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি যান। শেষ পর্যন্ত সব হারিয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের এই বাসিন্দা। ১২ বছরের শ্রম-সাধনায় তাঁর গড়া স্বপ্ন হরতাল-সমর্থকদের দেওয়া আগুনে মুহূর্তেই পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে।

ওমর ফারুক (৩৬) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার চুন্টা ইউনিয়নের চুন্টা গ্রামের বাসিন্দা। ২০০৯ সালে তিনি বাবার জমি বিক্রি করে ৫ লাখ সংগ্রহ করেন। সঙ্গে নিজের জমানো ৩ লাখ আর ঋণ নেন ২ লাখ টাকা। মোট ১০ লাখ টাকা দিয়ে শুরু করেন ব্যবসা। দোকান দেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল বিশ্বরোড মোড়ে খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানা কার্যালয়ের পাশে। সেখানে রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার, চাতাল কল, সেচপাম্পের মোটর ও মোটরের যন্ত্রাংশ বিক্রি করতেন। মোট পাঁচজন কাজ করতেন দোকানে। সবাই এখন বেকার।

বেঁচে থাকার অবলম্বন পুড়ে ছাই হওয়ার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বাক্‌রুদ্ধ হয়ে পড়ছিলেন ওমর ফারুক। বললেন, মা-বাবা, বড় ভাই ও স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর পাঁচজনের সংসার। এই ব্যবসা দিয়ে চলত পুরো সংসারের খরচ। তিল তিল করে গড়া সবই এখন শেষ। দোকানের জায়গায় আছে শুধু পোড়া চিহ্ন।

গন্ডগোলের শুরুটা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফর নিয়ে। এর অংশ হিসেবে গত ২৮ মার্চ হরতালের ডাক দেয় হেফাজতে ইসলাম। হরতাল-সমর্থকদের তাণ্ডবে ক্ষতবিক্ষত হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া। আক্রান্ত কার্যালয়গুলোর মধ্যে ছিল খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানাও। থানার প্রধান ফটকসংলগ্ন পশ্চিম পাশের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটি ছিল ওমর ফারুকের।

ওমর ফারুক হরতালের কথা শুনে ২৭ মার্চ রাত নয়টার দিকে দোকান বন্ধ করে বাড়িতে চলে যান। দোকান থেকে তাঁর বাড়ির দূরত্ব ১০ কিলোমিটার। থানার পাশেই দোকান বলে সব সময় মনে একটা অভয় কাজ করে। নিরাপদ ভেবেই প্রতিদিনের মতো দোকানেই রেখে দেন দেড় লাখ টাকা। সঙ্গে দোকানে ছিল ২৭ লাখ টাকার মালামাল। হরতালের দিন দোকান বন্ধ থাকবে, এ কথা দোকানের কর্মচারীসহ সবাইকে বলে দেন। ২৮ মার্চ বেলা একটার দিকে ফোন পান ফারুক। জানতে পারেন, থানা কার্যালয়ে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। রেহাই পায়নি তাঁর দোকানও। বড় ভাই ইমান উদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে যান বিশ্বরোড মোড়ে। মহাসড়কে দাঁড়িয়ে দুই ভাই দেখছেন, চোখের সামনে তাঁদের দোকানটা দাউ দাউ করে জ্বলছে। আশপাশে ১০-১২ জন যুবকের উল্লাস। এই দৃশ্য দেখে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন ওমর ফারুক। তাঁর মাথায় পানি ঢালতে শুরু করেন বড় ভাই ইমান উদ্দিন। এর মধ্যেই পরিবারের অন্যরা চলে আসেন। কিন্তু বিকেল সাড়ে পাঁচটার আগে কেউই দোকানের কাছে যেতে পারেননি। এমনকি তিনি যে দোকানের মালিক এ পরিচয়টুকুও দিতে পারেননি ফারুক। রাত আটটার দিকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা থানার আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। প্রায় একই সময়ে ফারুকের দোকানসহ আশপাশের চারটি দোকানের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন তাঁরা। এর আগেই আগুনে সব শেষ।

ওমর ফারুক কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, ‘আমার মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারব না। আমার দোকানে এমন কোনো যন্ত্রপাতিও নেই, যা দিয়ে আমি কোথাও মেরামতের কাজ করব। আজ (গতকাল বুধবার) ১০ দিন হলো। কেউ কোনো খোঁজও নিল না। আমি মামলাও দিতে পারছি না। কারণ, কেউই সাক্ষী হতে রাজি নন। তা ছাড়া আমার কোনো অর্থও নেই যে আমি মামলা চালাব। আমি কার কাছে যাব? কে চালাবে আমার সংসার। কী ছিল আমার অপরাধ?’

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (সরাইল সার্কেল) আনিছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পাশে আছে পুলিশ। মামলা দিলে তাঁরা অবশ্যই আইনগত সহায়তা পাবেন।