দৌলতদিয়া ঘাটে আসছে মানুষ, ট্রাকে গন্তব্যে ছুটছে অনেকে

সরকার ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধের তৃতীয় দিন রোববার ভোরেও রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ঘাটে মানুষের চাপ ছিল।
ছবি: এম রাশেদুল হক

করোনা সংক্রমণ রোধে সরকারের বেঁধে দেওয়া ১৪ দিনের কঠোর বিধিনিষেধের আজ রোববার ছিল তৃতীয় দিন। গত দুই দিনের মতো আজ ভোর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে আসা লোকজন ভিড় করছেন রাজধানীর অন্যতম প্রবেশপথ রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ঘাটে। সঙ্গে আসছে বিভিন্ন ধরনের যানবাহন। একইভাবে নদী পাড়ি দিয়ে আসা দক্ষিণাঞ্চলগামী যানবাহনের সঙ্গে মানুষ আসছেন।

রোববার সকালে দৌলতদিয়া ঘাটে দেখা যায়, বিভিন্ন জেলা থেকে রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স, পণ্যবাহী গাড়ি নদী পাড়ি দিতে দৌলতদিয়া ঘাটে আসছে। সেই সঙ্গে কিছু ব্যক্তিগত গাড়ি, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেলও দেখা যায়। এ ছাড়া ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, মাহেন্দ্রতে করেও অনেকে ঘাটে এসে নামছেন। দূরপাল্লার পরিবহন চলাচল বন্ধ থাকায় কাউকে কাউকে খোলা ট্রাকে চলাচল করতে দেখা যায়। আবার পন্টুনের ওপর অনেককে ফেরির জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

একইভাবে দুই দিন ধরে ভোর হলেই লোকজন ও মোটরসাইকেল পারাপার হওয়ায় গতকাল শনিবার দুপুর থেকে কঠোর অবস্থান নেয় প্রশাসন। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ভ্রাম্যমাণ আদালত দৌলতদিয়া ফেরিঘাট এলাকায় অবস্থান নিয়ে ঘাটে আসা যাত্রীদের ফিরিয়ে দেন। অনেক মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার ঘুরিয়ে দেন। এ সময় কেউ কেউ বাধা পেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এ ছাড়া কয়েকজনের কাছ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানাও আদায় করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। আদালত পরিচালনা করেন গোয়ালন্দের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রফিকুল ইসলাম। এরপর আজ ভোর থেকে যানবাহনের সঙ্গে খুচরা যাত্রী ও মোটরসাইকেল আরোহীদের আনাগোনা দেখা যায়।

সকাল নয়টার দিকে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাট থেকে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন নামক একটি রো রো (বড়) ফেরি দৌলতদিয়ার ৫ নম্বর ঘাটে এসে ভেড়ে। তাতে কয়েকটি পণ্যবাহী গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স দেখা যায়। এ ছাড়া খোলা ট্রাকে যাত্রী বহন করতেও দেখা যায়। ফেরি থেকে নামার সময় মেহেরপুরগামী ট্রাকের যাত্রী আবদুর রাজ্জাক বলেন, ঢাকার মিরপুর এলাকায় একটি বেসরকারি উৎপাদনমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানে তিনি কাজ করেন। ঈদের এক দিন আগে পরিবার নিয়ে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি মেহেরপুর এসেছিলেন। ঈদ শেষে পরদিনই আবার ঢাকায় ফিরে গেছেন। গতকাল শনিবার রাতেই খবর আসে, বাবা খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কী আর করার? ভোররাতে ঢাকা থেকে রওনা হয়েছেন। গাবতলী থেকে একটি ট্রাকে করে ৬০০ টাকায় কুষ্টিয়া যাবেন। সেখান থেকে বিকল্প উপায়ে মেহেরপুর যাবেন।

ট্রাকচালক বাবলু সরদার বলেন, শনিবার রাতে কাঁচামাল নিয়ে কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় গিয়েছিলেন। রাতে কারওয়ান বাজারে কাঁচা সবজি নামানোর পর ভোররাতেই আবার রওনা করেন। পথে কয়েকজন যাত্রীর জোর অনুরোধে তুলেছেন। কেউ রাজবাড়ী, কেউ কুষ্টিয়া পর্যন্ত যাবেন। পথে কোনো গাড়ি নেই, তাই নির্ধারিত ভাড়া তাঁদের কাছ থেকে নিচ্ছেন বলে তিনি দাবি করেন।

ফরিদপুরের ঈশান গোপালপুর গ্রামের বাড়িতে একমাত্র ১০ দিন বয়সী ছেলেসন্তানের লাশ নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে ফিরছিলেন বাবা পাসপোর্ট অফিসের স্টাফ আবদুল আলিম। ঘাটে আলাপকালে তিনি বলেন, অনেক দিন পর তাঁদের ঘরে একটি ছেলেসন্তানের জন্ম হয়েছে। জন্মের পর থেকে বাচ্চাটির বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। গতকাল রাতে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে মাথার জরুরি অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপচার শেষে রাতেই তাঁর ছেলেসন্তানটি মারা যায়। আল্লাহ এত দিন পর একটি সন্তান দিল, তা–ও আবার কেড়ে নিল। এখন গ্রামের বাড়ি দাফনের জন্য নিয়ে যাচ্ছেন, বলেই তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন।

এদিকে ফরিদপুরের নগরকান্দা থেকে জরুরি দাপ্তরিক কাজে ঢাকায় যাচ্ছিলেন কৃষ্ণ চক্রবর্তী। এ জন্য তিনি একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা রিজার্ভ করে খুব সকালেই রওনা হন। তাঁর সঙ্গে স্থানীয় আরও তিনজন ঢাকায় যাবেন বলে ওই অটোরিকশায় রওনা হন। সকাল সাড়ে আটটার দিকে পথে কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে পৌঁছান।

আলাপকালে কৃষ্ণ চক্রবর্তী, জুয়েল রানাসহ কয়েকজন বলেন, ‘আমাদের কাজ তো আর বন্ধ নেই। যত লকডাউন হোক আর কঠোর লকডাউন হোক। কাজ করতে না পারলে চাকরি থাকবে না, পেটে ভাতও জুটবে না। তাই অফিসের কাজে, কেউ ব্যবসার কাজে ঢাকায় যেতে হচ্ছে। তবে পথে ঝামেলা এড়াতেই খুব ভোরে রওনা হয়েছি। এখন নদী পাড়ি দিয়ে পাটুরিয়া থেকে ভালোভাবে ঢাকা পৌঁছাতে পারলেই ভালো। সময়মতো পৌঁছাতে না পারলে তো বিপদ।’

ঘাটে কর্তব্যরত বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) দৌলতদিয়া কার্যালয়ের সহকারী ব্যবস্থাপক মো. খোরশেদ আলম বলেন, যানবাহনের চাপ কম থাকায় বর্তমানে পাঁচটি রো রো এবং তিনটি ইউটিলিটি ফেরি চলাচল করছে। তবে যানবাহনের চাপ বাড়লে প্রয়োজনে ফেরির সংখ্যাও বাড়ানো হবে।

যাত্রী পারাপারের ব্যাপারে মো. খোরশেদ আলম বলেন, ‘ভোর থেকেই বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের সঙ্গে খুচরা যাত্রী ও মোটরসাইকেল আরোহী দেখা যায়। তবে গতকাল প্রশাসনের কড়া অবস্থানের কারণে আজ কিছুটা কম দেখছি। এ ছাড়া আমরাও তাঁদের পারাপারে নিরুৎসাহিত করছি।’