দৌলতদিয়া ঘাটে রাজধানী ও দক্ষিণাঞ্চলগামী মানুষের ভিড়

কঠোর বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে আসা মানুষজন এভাবে রাজধানীর দিকে ছুটছেন। বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ার ফেরিঘাটে
ছবি: এম রাশেদুল হক

করোনা সংক্রমণ রোধে সরকারের জারি করা কঠোর বিধিনিষেধ যেন কোনো বাধাই না। সব বাধাকে অতিক্রম করে সবাই ছুটছেন যাঁর যাঁর গন্তব্যে। ১৪ দিনের কঠোর বিধিনিষেধের আজ বুধবার ষষ্ঠ দিনে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে এ চিত্র দেখা গেছে। সব বাধা অতিক্রম করে একদিকে রাজধানীমুখী, অন্যদিকে দক্ষিণাঞ্চলমুখী মানুষের ভিড় এই ঘাটে বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাধা উপেক্ষা করে তাদের সামনে দিয়েই সকাল থেকেই ছুটছেন মানুষ। কারও ঈদের ছুটি শেষ, কেউবা কাজের সন্ধানে, আবার কেউ জরুরি কাজে ছুটছেন। এমন নানা অজুহাতে উভয় দিকের ছুটে চলা মানুষের ভিড় বেলা বাড়ার সঙ্গে বাড়তে থাকে।

সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় অবস্থান করে দেখা যায়, দৌলতদিয়া ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া নৌপথে সব ধরনের লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। শুধু ফেরি চলাচল অব্যাহত রয়েছে। জরুরি গাড়ি, পণ্যবাহী গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স পারাপারের কথা থাকলও নানা অজুহাতে মোটরসাইকেল আরোহী, সাধারণ যাত্রী অহরহ পার হচ্ছেন। মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কঠোর অবস্থান নিলে যাত্রীর চাপ কিছুটা কমছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এক ঘাটে অবস্থান নিলে আরেক ঘাট দিয়ে মানুষ পারাপার হন। এ ঘাট-ও ঘাট প্রশাসন ও যাত্রীদের এ লুকোচুরি খেলা চলতে থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঘাট ছাড়তেই সব বাধানিষেধ যেন উঠে যায়।

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে মোটরসাইকেল, মাইক্রোবাস, অটোরিকশা, এমনকি ভ্যানে করে যাত্রীরা ফেরিঘাটে আসছেন। ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা থেকে ভ্যানে করে দৌলতদিয়া এসেছেন রেজাউল করিম। তিনি বলেন, সাভারের নবীনগরের একটি বেসরকারি কারখানায় কাজ করেন। স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে করে ঈদের পরদিন আসেন গ্রামের বাড়ি। ১ আগস্ট থেকে কারখানা খোলা। তাই তিনি কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও ছুটছেন। তিনি বলেন, ‘দেখুন আমি যদি না যাই, তাহলে তো আমার আর কাজ থাকবে না। পরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে খাব কী? চলব কীভাবে? তাই কষ্ট হলেও যেতে হবে।’

বিআইডব্লিউটিসি দৌলতদিয়া কার্যালয় জানায়, তাদের কাছে যাত্রী ঠেকানোর কোনো নির্দেশনা নেই।

ঢাকার উত্তরার একটি চায়নিজ রেস্তোরাঁয় ওয়েটার হিসেবে কাজ করেন রাকিবুল ইসলাম। তিনি ঈদের তিন দিন আগে গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া এসেছিলেন। আজ অটোরিকশা রিজার্ভ করে দৌলতদিয়া ঘাটে আসেন। দুপুরে ফেরিঘাটে আলাপকালে বলেন, কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও যেতে হচ্ছে। গতকাল রেস্তোরাঁ থেকে ফোন করে যেতে বলেছে। এ কারণে কষ্ট করে হলেও ঢাকায় যাচ্ছেন।

বৈরী আবহাওয়ার কারণে নদী উত্তাল থাকায় নদীতে স্রোতের পাশাপাশি বড় বড় ঢেউ দেখা যায়। উত্তাল ঢেউ পেরিয়ে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে ছোট-বড় মিলে চলাচল করছে ৭টি ফেরি। পাটুরিয়া ঘাট থেকে আসা প্রতিটি ফেরিতে যানবাহনের সঙ্গে ১০০ থেকে ১৫০ জনের মতো যাত্রী দেখা যায়। একইভাবে দৌলতদিয়া ঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়া প্রতিটি ফেরিতে যানবাহনের সঙ্গে অন্তত ২০০ থেকে ৩০০ জনের মতো যাত্রী পার হতে দেখা যায়। এসব যাত্রীর কাছে করোনা বা লকডাউন কোনো বাধাই না।

ঘাট ছেড়ে যাচ্ছে ফেরি। যানবাহনের সঙ্গে ফেরিতে উঠছেন যাত্রীরা। বুধবার দুপুরে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ার ৬ নম্বর ফেরিঘাটে
ছবি: এম রাশেদুল হক

নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ার ফকির নিটওয়্যারে চাকরি করেন রাজবাড়ীর পাংশার কসবা মাজাইল এলাকার আব্দুর রাজ্জাক। ঈদের আগে ছুটিতে তিনি স্ত্রীকে সঙ্গে করে বাড়িতে ঈদ করতে আসেন। আজ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তিনি দৌলতদিয়া ফেরিঘাট দিয়ে নিজের কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘বাড়িতে বাবা-মা রয়েছে। বাবা-মার সঙ্গে ঈদ করতেই স্ত্রীকে সঙ্গে করে এসেছিলাম। এ ছাড়া এবার আমাদেরও লম্বা ছুটি ছিল। কিন্তু এখন ১-২ দিনের মধ্যে অফিস খুলবে। তাই আজই রওনা হয়েছি।’ কীভাবে এলেন জানতে চাইলে বলেন, ‘সকাল ৮টার দিকে বাড়ি থেকে একটি অটোরিকশায় করে এসেছি। আমার মতো আরও কয়েকজন এসেছেন। প্রত্যেকের কাছ থেকে জনপ্রতি ২০০ টাকা করে ভাড়া নিয়েছে।’

ঢাকার মালিবাগে পুলিশের বিশেষ শাখায় চাকরি করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা। তিনিও এসেছিলেন রাজবাড়ীর পাংশা এলাকার গ্রামের বাড়িতে। জানতে চাইলে বলেন, গ্রামের বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে স্ত্রীও রয়েছেন। তিনি অন্তঃসত্ত্বা। ঈদের দুই দিন পর স্ত্রী বেশি অসুস্থ হওয়ায় বাড়ি এসেছিলেন। এখন তাঁদের রেখে কর্মস্থলে ছুটছেন। এখন কঠোর বিধিনিষেধ থাকলেও তো কিছুই করার নেই। কর্মস্থলে তো যেতেই হবে।

কঠোর বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে আসা মানুষজন এভাবে রাজধানীর দিকে ছুটছেন। বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ার ফেরিঘাটে
ছবি: এম রাশেদুল হক

টাঙ্গাইল থেকে স্ত্রীকে নিয়ে নিজের কর্মস্থল বালিয়াকান্দির খাদ্য অধিদপ্তর কার্যালয় যাচ্ছেন মামুন-অর রশিদ। দৌলতদিয়া ৬ নম্বর ফেরিঘাটে দুপুর ১২টার দিকে আলাপকালে বলেন, ‘ঈদের আগে বাড়ি ছিলাম। এখন অফিসে ফিরতে হবে। তাই কী আর করার? সকাল ৬টার দিকে টাঙ্গাইল থেকে মাইক্রোবাস ভাড়া করে পাটুরিয়ায় আসি। এখন নদী পাড়ি দিয়ে দৌলতদিয়ায় আসার পর অটোরিকশা রিজার্ভ করে বালিয়াকান্দি যাচ্ছি।’

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) দৌলতদিয়া কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক জামাল হোসেন বলেন, তাঁদের কাছে যাত্রী ঠেকানোর কোনো নির্দেশনা নেই। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে। তবে তাদের বাধা উপেক্ষা করেই যাত্রীরা পারাপার হচ্ছেন। তাঁরা যাত্রীবাহী কোনো যানবাহনের টিকিট দিচ্ছেন না। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ছোট-বড় মিলে ৭টি ফেরির সঙ্গে দুটি মাঝারি আকারের মিলে মোট ৯টি ফেরি চালু রয়েছে।