ধসে পড়ল নর্দমা, আবাসন প্রকল্পের ঘরও ঝুঁকিতে

পায়রা বন্দরের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করায় যাঁদের বসতঘর, কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাঁদের এসব আবাসনে পুনর্বাসন করা হচ্ছে।

পায়রা বন্দরের ভূমি অধিগ্রহণের সময় যাঁদের ঘরবাড়ি ও কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তাঁদের পুনর্বাসনের জন্য নির্মাণাধীন ঘর ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে। ইতিমধ্যে আবাসন এলাকায় পানিনিষ্কাশনের জন্য নির্মিত নর্দমা ধসে পড়েছে।

আবাসন প্রকল্পটি পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের মহল্লাপাড়ায় অবস্থিত। অপর দিকে মহল্লাপাড়া ও মেরাউপাড়া গ্রামে নির্মিত ঘরের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ঘর বরাদ্দ পাওয়া বাসিন্দারা।

পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় ওই গ্রাম দুটিতে আলাদা করে দুটি আবাসন নির্মাণ করা হচ্ছে। ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেড পায়রা বন্দরের কাছ থেকে আবাসন নির্মাণের কাজটি পেয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কাজটি নিয়ে বর্তমানে বাস্তবায়ন করছে ই-ইঞ্জিনিয়ারিং নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। পায়রা বন্দরের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করায় যাঁদের বসতঘর, কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাঁদের এসব আবাসনে পুনর্বাসন করা হচ্ছে।

গত বুধবার দেখা গেছে, প্রবল বর্ষণে ২ নম্বর গুচ্ছের (প্যাকেজ) মহল্লাপাড়া আবাসনের নির্মিত নর্দমা ধসে পড়েছে। তা ছাড়া আবাসন প্রকল্পের যে পাকা ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলোর পাশের বালু সরে গেছে। ঘরগুলো এখন ঝুঁকির মুখে রয়েছে। এ আবাসনের বাসিন্দাদের জন্য দুটি পুকুর খনন করা হয়েছিল। প্রবল বর্ষণের কারণে পুকুর দুটির চারপাশের মাটি ধসে পড়েছে। পুরো আবাসন এলাকায় বালু ফেলে উঁচু করা হয়েছিল। বর্ষায় বালু ধুয়ে গিয়ে অসংখ্য ছোট-বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।

মহল্লাপাড়া গ্রামের সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই আবাসন দুটির কাজের মান নিয়ে আপত্তি করেছিলাম। যাঁরা কাজটি বাস্তবায়ন করছেন, তাঁরা কোনো কথার মূল্য দেন না। তাঁদের কাছে পাত্তাই পাওয়া যায় না।’ মহল্লাপাড়া আবাসন এলাকার কমপক্ষে ৫০০ ফুট নর্দমা ধসে পড়েছে বলে তিনি জানান।

* প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পর মহল্লাপাড়ার ৩৮৬টি ও মেরাউপাড়া আবাসনের ১১৪টি ঘরের চাবি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। * আবাসন প্রকল্পের যে পাকা ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলোর পাশের বালু সরে গেছে। * প্রতিটি ঘরে নিম্নমানের কাজ করা হয়েছে বলে ক্ষতিগ্রস্তরা অভিযোগ করেছেন।

পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা সূত্রে জানা গেছে, ২ নম্বর গুচ্ছের আওতায় মহল্লাপাড়া গ্রামে ৬০০টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ৩৮৬ জনকে ঘর বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানকার ২১৪টি ঘরের বরাদ্দ এখনো বাকি রয়েছে। অন্যদিকে ১ নম্বর গুচ্ছের আওতায় মেরাউপাড়া গ্রামে ১১৪টি ঘর নির্মিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৬ মে ভিডিও কনফারেন্স করে এসব ঘরের উদ্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পর মহল্লাপাড়ার ৩৮৬টি ও মেরাউপাড়া আবাসনের ১১৪টি ঘরের চাবি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা আবাসন প্রকল্পের ঘরগুলোতে বসবাস শুরু করেন।

মহল্লাপাড়া আবাসনের ৩৯ নম্বর ঘরের বাসিন্দা মো. মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘আমাগো ঘর দেওয়া হইছে ঠিকই, কিন্তু এসব ঘরের ছাদ চুইয়া পানি পড়ে। দেয়াল ভিজ্যা যাওয়ায় পলেস্তারা ফুইল্যা ফোসকা ফোসকা হইছে। চাপ দিলেই বালু ভাইংগ্যা পইড়্যা যায়। তা ছাড়া ছাদ চুইয়া পানি পড়তে পড়তে ওই জায়গাগুলান কালো হইয়া গেছে। বাথরুমের মেঝেতে পানি জমে থাকে। এই সব কারণে ঘরে বসবাস করাই তো আমাগো জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হইয়া পড়ছে।’

এ আবাসনের ১৩২ নম্বর ঘরের বাসিন্দা জোনাব আলী হাওলাদার বলেন, ‘ঘরের ছাদ ঢালাই দেওয়ার পর পানি দিয়া ভিজাইয়া রাখার নিয়ম থাকলেও তা করা হয়নি। ঘরের দেয়ালে, ফ্লোরের (মেঝে) কোথাও পানি দেওয়া হয়নি। আমরা গ্রামের মানুষরা কইয়াও এ কথা হুনাইতে পারি নাই। প্রতিটি ঘরে নিম্নমানের কাজ করা হয়েছে।’

ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের এ মানুষটি আরও বললেন, প্রকল্প এলাকার পূর্ব পাশ বালু ফেলে উঁচু করা হয়েছে। আর পশ্চিম পাশ ঢালু রয়ে গেছে। যার কারণে বর্ষার পানি স্রোতের মতো পশ্চিম দিকে নামছে। এর ফলে সবকিছু ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ভুলের কারণে এমন দুরবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানালেন তিনি।

মেরাউপাড়া গ্রামে নির্মিত ঘরগুলোও মহল্লাপাড়া গ্রামের আবাসনের মতো ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানালেন এখানে বসবাসকারী লোকজন। মেরাউপাড়া গ্রামের ২৯ নম্বর ঘরের বাসিন্দা মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘পায়রা বন্দরের উন্নয়নকাজে আমাগো বাড়িঘর, জমি–জিরাত সব চইল্যা গেছে। হেইয়ার বিনিময়ে একটা পাকা ঘর পাইছি। মনে করছেলাম, শান্তিতে বসবাস করতে পারমু। কিন্তু ঘরের অবস্থা এখনই খারাপ। কোনো রহম একটা ঘর তুইল্যা আমাগো বুঝাইয়া দেছে। মোগো একুল-ওকুল—সবই গেছে।’

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ই-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রকল্প ব্যবস্থাপক আবদুল্লাহ আল মোস্তাইন বলেন, ‘আমাদের প্রকল্পের কাজ মাত্র ৬০ ভাগ শেষ হয়েছে। এখনো ৪০ ভাগ কাজ বাকি। দুর্যোগে যতটুকু ক্ষতি হয়েছে, তা নিরূপণ করার চেষ্টা চলছে। তা ছাড়া যা ক্ষতি হয়েছে, তা আমরা চলমান সময়ের মধ্যে মেরামত করে দিতে পারব।’

পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মহিউদ্দিন আহম্মেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ওপর কারও হাত নেই। দুর্যোগের কারণে এমন ক্ষতি হয়েছে। আমরাও উদ্যোগ নিচ্ছি। আর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকেও ক্ষতি নিরূপণ করে তা মেরামত করার জন্য বলা হয়েছে।’ নির্মিত ঘরগুলোর কাজের মান সম্পর্কে স্থানীয় ব্যক্তিদের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা ঘরের কাজ নিয়ে কোনো কিছু জানতাম না। এখন যেহেতু শুনলাম, আমরা খতিয়ে দেখব। যদি কোনো অনিয়ম হয়ে থাকে, সে ব্যাপারেও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’