ধান ছেড়ে ফলে ঝোঁক

প্রতিবছর বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সেচে ব্যাঘাত ঘটে। এ কারণে ফলের বাগান করার দিকে ঝুঁকছেন অনেকে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের বরেন্দ্র অঞ্চলে গত ১০ বছরে ধান চাষ হয় এমন জমির পরিমাণ কমে গেছে ১১ হাজার ১৭৮ হেক্টর। এই সময়ে এসব জমিতে আম, পেয়ারা, বরইসহ মাল্টার চাষ বেড়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ বছরে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন ঘটেছে সদর উপজেলায়। এ উপজেলার ৫ হাজার ১৩৩ হেক্টর জমিতে গড়ে উঠেছে আমবাগান। এ ছাড়া গোমস্তাপুরে ৪ হাজার ২০৫ হেক্টর, নাচোলে ১ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমিতে এখন পেয়ারা, বরই ও মাল্টার চাষ হচ্ছে। ১০ বছর আগে এর পরিমাণ ছিল অনেক কম।

কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এবং দিন দিন বরেন্দ্র অঞ্চলে ধান চাষ অলাভজনক হওয়ায় এসব জমিতে ক্রমাগত আমসহ বিভিন্ন ফলের বাগান করার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। ফলে ধানের ভান্ডার হিসেবে পরিচিত বরেন্দ্রভূমি এখন ফলের ভান্ডার হওয়ার দিকে যাচ্ছে। এতে ধান চাষের সঙ্গে জড়িত দিনমজুরেরা কর্ম হারাচ্ছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের চাঁপাইনবাবগঞ্জ কার্যালয়ের উপপরিচালক নজরুল ইসলাম বলেন, ফলের বাগান ছাড়াও পুকুর খনন, কলকারখানা, ঘরবাড়ি ও ইটভাটা নির্মাণের কারণেও বরেন্দ্র অঞ্চলে ধানিজমির পরিমাণ কমেছে।

এদিকে বরেন্দ্র এলাকায় প্রতিবছর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামছে। এতে ধানের জমিতে সেচের সংকট তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে বোরো ধানের আবাদে ২০ থেকে ২২ বার সেচ দিতে হয়। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পানি উঠছে না। বিপরীতে ফলের বাগানে তিন থেকে চারবার সেচ দিলেই চলে। এ কারণেও ধান চাষে জমির মালিকেরা আগ্রহ হারাচ্ছেন বলে জানা গেছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলায় গত তিন বছরে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে তিন ফুট। সদর, শিবগঞ্জ ও ভোলাহাট উপজেলায় ১০০ ফুটের কম গভীরতার নলকূপগুলোতে পানি উঠছে না। গোমস্তাপুর উপজেলায় এই গভীরতা ১২০ ফুট এবং নাচোলে ১৫০ ফুট।

কয়েকজন জমিমালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁরা এখন শহরে থাকেন। ফসলের দেখাশোনা ও তদারকি করার ঝামেলা পোহাতে চান না। তাই ফল চাষের উদ্যোক্তাদের কাছে চুক্তির ভিত্তিতে জমি বন্দোবস্ত দিচ্ছেন। এতে ধান চাষ করে যে আয় হয়, তার চেয়ে বেশি অর্থ পাওয়া যাচ্ছে।

স্থানীয় কৃষক, ফলচাষি ও কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফল চাষের উদ্যোক্তারা বরেন্দ্র অঞ্চলের জমির মালিকদের কাছ থেকে ১০ থেকে ১৫ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্ত নিয়ে বাগান গড়ে তুলছেন। প্রতিবছর বিঘাপ্রতি ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা দিয়ে জমি বন্দোবস্ত নিচ্ছেন তাঁরা। এতে জমির মালিক ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও কর্মহীন হয়ে পড়ছেন বর্গাচাষি ও কৃষিশ্রমিকেরা।

সম্প্রতি নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের টকটকা এলাকায় দীর্ঘমেয়াদি লিজের মাধ্যমে আমবাগান গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এতে বাধা দেন ওই এলাকার বর্গাচাষিরা। এ নিয়ে তাঁরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে স্মারকলিপিও দেন। টকটকা এলাকার বর্গাচাষি সাদিকুল ইসলাম বলেন, ‘আইজ ১৫ বছর থ্যাকা হ্যামি জমিতে ধানের আবাদ করছুনু। হামি জোতদারের হাত ধরনু, পা ধরনু , কিছুই হইল না। কষ্টে হামার অন্তর ফাইট্যা যাইছে।’

টকটকা এলাকার আরেক বর্গাচাষি ধীরেন টুডু বলেন, আগে এসব জায়গায় বাগান ছিল না। এখন যেসব জমিতে বছরে দুবার ধানের আবাদ হচ্ছে, সেসব জমিতেও বাগান করার জন্য লোকজন মালিকদের কাছে ঘুরছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নজরুল ইসলাম বলছেন, সাময়িক লাভের কথা না ভেবে সুদূরপ্রসারী চিন্তার সময় এসেছে।