ধানসিড়ি খননে অনিয়ম

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নদী খননের বালু ও মাটি দূরে ফেলেনি। পাড়ে ফেলা বালু-মাটি আবার নদীতে গিয়ে পড়েছে।

ঠিকভাবে খনন না করায় ধানসিড়ি নদীটি যেন খালে পরিণত হয়েছে। খনন করে মাটি দূরে ফেলা হয়নি। আবার সেই মাটি নদীর পানিতে মিশে যাচ্ছে
ছবি: প্রথম আলো

একসময় ঝালকাঠির রাজাপুরে ধানসিড়ি নদীটি প্রস্থে ৫০০ ফুটের বেশি ছিল। চলত বড় বড় জাহাজ। আগেই রূপ–জৌলুশ হারিয়েছে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের স্মৃতিবিজড়িত নদীটি। এখন এটি মৃতপ্রায়। ঠিকঠাক খনন না হওয়ায় পানির প্রবাহ নেই। ফলে দুই পারে কয়েক হাজার হেক্টর জমি অনাবাদি পড়ে আছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নদী খননের বালু ও মাটি দূরে ফেলেনি। পাড়ে ফেলা বালু–মাটি আবার নদীতে গিয়ে পড়েছে।

উপজেলা ভূমি কার্যালয় সূত্র জানায়, ১৯১০ সালের সিএস নকশা অনুযায়ী ৩৬০ দাগে রাজাপুরের বাগড়ি অংশে এ নদীর মোহনার প্রস্থ ছিল ৫৬৭ ফুট। এ নদীর মোহনায় তখন ছিল দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় বন্দর। বড় বড় জাহাজ ভিড়ত। এখান থেকে কলকাতায় সরাসরি জাহাজ চলাচল করত। এরপর ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ১৯৫০ সালে পাকিস্তান সরকারের জরিপে ১ নম্বর দাগে ধানসিড়ি নদীর মোহনার প্রস্থ পাওয়া যায় ২০০ ফুট। এই জরিপের নকশা এখনো চলমান। অথচ নদীটির বর্তমান অবস্থা যায় যায়।

ঝালকাঠি পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্যমতে, সরকারের ডেল্টা প্ল্যান অনুযায়ী ৬৪ জেলার অভ্যন্তরে ছোট নদী ও খাল খনন প্রকল্পের আওতায় ধানসিড়ি নদীটি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ বছর মেয়াদে ২ কিস্তিতে সাড়ে ৮ কিলোমিটার পুনঃখননের জন্য প্রায় ৪ কোটি ৪৯ লাখ ৩৮ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের মার্চে ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নদীটি ঝালকাঠি সদর উপজেলার গাবখান নদীর মোহনা থেকে দেড় কিলোমিটার বাদ দিয়ে রাজাপুরের বাগড়ি বাজারের জাঙ্গালিয়া নদীর মোহনা পর্যন্ত মোট সাড়ে ৮ কিলোমিটার খনন শুরু হয়।

প্রকল্পের কার্যাদেশে নদীর ওপরে প্রস্থ ৮০ ফুট, সমতল থেকে নদীর গভীরতা ১৫ ফুট ও নদীর তলদেশে প্রস্থ ২০ ফুট ধরা হয়। কার্যাদেশে আরও উল্লেখ করা হয়, নদীর তলদেশ থেকে মাটি কেটে পাড় থেকে দূরে সরিয়ে নিতে হবে। কিন্তু তখন খননকাজে পাউবোর তদারকি না থাকায় ঠিকাদার অনিয়মের মাধ্যমে কাজ শেষ করে। পরে বর্ষা মৌসুমে খনন করে রাখা নদীর পাড়ের মাটি পড়ে তলদেশ ভরাট হয়ে যায়। তখন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ছিল ঢাকার পুরানা পল্টনের আরএবি-পিসি (প্রা.) লিমিটেড ও মৈত্রী (প্রা.) লিমিটেড। এর আগে ২০১০-১১ অর্থবছরে প্রায় ৮৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ধানসিড়ি নদীটি খনন করা হয়েছিল, যা পরে কোনো কাজে আসেনি।

২০২১-২২ অর্থবছরে ধানসিড়ি খননের জন্য পুনরায় পাউবো প্রস্তাব পাঠালে নতুন করে নদীর তলদেশ খননের জন্য ১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা বরাদ্দ আসে। এবার কাজ পান পটুয়াখালীর ঠিকাদার আবুল কালাম আজাদ। তিনি ১৫ দিন আগে ধানসিড়ি নদীর তলদেশ খননের কাজ শুরু করেন। আগের মতো এবারও মাটি কেটে নদীর পাড়েই রাখা হচ্ছে। আবুল কালাম বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ড যেভাবে লে-আউট দিয়েছে, সেভাবেই আমি নদী খনন করছি। দুই পাড়ের মাটি সরিয়ে দূরবর্তী নিচু জমিতে ফেলার ব্যবস্থা করছি।’

সরেজমিনে দেখা যায়, ধানসিড়ি নদী সঠিকভাবে খননের অভাবে নদীতে পানির প্রবাহ না থাকায় দুই পারে কয়েক হাজার হেক্টর জমি অনাবাদি পড়ে আছে। পানির অভাবে শুকনা মৌসুমে কৃষকেরা জমিতে চাষাবাদ করতে পারছেন না।

খননকাজে অনিয়মের প্রতিবাদে ৭ এপ্রিল সকালে বরিশাল–খুলনা আঞ্চলিক মহাসড়কে রাজাপুরের বাগড়ি বাজারসংলগ্ন এলাকায় মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন এলাকাবাসী। তাঁরা বলেন, ২ বছর আগেও যে নদীর প্রশস্ততা ৮০ ফুট রেখে খনন করা হয়েছিল, সেই নদী এবার খননে প্রস্থ ধরা হয়েছে ৪৯ থেকে ৫৫ ফুট; যা একটি খালের সমান। নদীর তলদেশের মাটি উঠিয়ে নদীর পাড়ে ফেলে প্রস্থ কমিয়ে ফেলা হয়েছে। এ খননকাজ লোক দেখানো। স্থানীয় ব্যক্তিরা এমন খনন চান না। এসএ নকশা অনুযায়ী এ নদীর খনন চান তাঁরা।

স্থানীয় মঠবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ জালাল আহম্মেদ বলেন, নদীর তলদেশ খনন করে মাটি দূরে সরানোর কথা থাকলেও ঠিকাদারেরা ইচ্ছে করেই মাটি না সরিয়ে নদীর পাড়ে রাখেন। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সেই মাটি নদীতে পড়ে আবার ভরাট হয়ে যায়।

ঝালকাঠি পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিব হাসান বলেন, ধানসিড়ি নদীর তলায় চার ফুট খনন করা হচ্ছে। ওপরের প্রশস্ততা এর আগে যেমন ছিল তেমনই থাকবে। খননে ঠিকাদার কিছু কিছু জায়গায় ভুল করেছিল। স্থানীয় ব্যক্তিদের অভিযোগের ভিত্তিতে সেগুলো ঠিক করতে বলা হয়েছে।