ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে নতুন করে জীবন শুরুর চেষ্টা

বাঁশ ও ত্রিপল দিয়ে ঘর তৈরি করছে অনেকে। খাবার ও পানির সংকট

পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বসতঘর। অবশিষ্ট নেই কিছুই। বিভিন্ন এনজিও ও সরকারিভাবে পাওয়া ঘর নির্মাণের কিছু উপকরণ পেয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো। পুড়ে যাওয়া ঘরে সন্তানদের নিয়ে বসে আছেন এক নারী। গতকাল দুপুরে কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা শিবিরে
ছবি: এএফপি

কক্সবাজারের উখিয়ায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গারা নতুন করে জীবন শুরুর চেষ্টা করছে। ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে অনেকেই বাঁশ ও ত্রিপল দিয়ে নতুন করে ঘর তৈরির চেষ্টা করছে। এদিকে ঘরহারা রোহিঙ্গারা এখনো খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাচ্ছে। তারা ভুগছে খাবার ও পানির তীব্র সংকটে।

গত সোমবারের অগ্নিকাণ্ডে উখিয়ার পাঁচটি রোহিঙ্গা শিবিরের প্রায় ১০ হাজার ঘর পুড়ে যায়। এতে ঘর হারায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা।

গতকাল বুধবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত উখিয়ার পাঁচটি রোহিঙ্গা শিবির ঘুরে দেখা যায়, চারদিকে আগুনে পুড়ে যাওয়া ধ্বংসস্তূপ। খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছে রোহিঙ্গারা। ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে অনেকেই বাঁশ ও ত্রিপল দিয়ে নতুন করে ঘর তৈরির চেষ্টা করছে। কিছু রান্না করা খাবার পেলেও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কাছে নেই থালা-বাসন, হাঁড়ি–পাতিল, এমনকি পানি খাওয়ার জন্য কোনো জগ–গ্লাস। বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) সরবরাহ করা কনটেইনার নিয়ে খাওয়ার পানি সংগ্রহে তাঁরা ছুটছেন পাশের এলাকায়। শিবিরের এক পাশে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির উদ্যোগে ৮০০ তাঁবু তৈরির কাজ চলছে।

বালুখালীর রোহিঙ্গা শিবিরের সি ব্লকের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম ও মোহাম্মদ হাসান বলেন, সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কোনো জিনিসপত্র, টাকাপয়সা নেই। আসবাব পুড়ে মাটিতে মিশে গেছে। সেসবের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করে এনজিওর কাছ থেকে পাওয়া বাঁশ ও পলিথিন দিয়ে নতুন ঘর তৈরির চেষ্টা করছেন তাঁরা।

একই শিবিরের বাসিন্দা হামিদা বেগম বলেন, ‘তিন বছর আগে নিজ দেশে অত্যাচার-নির্যাতনের মুখে ঘরবাড়ি ও জমিজমা ফেলে এখানে পালিয়ে এসে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসতি করে কোনো রকমের দিন যাপন করছিলাম। এখন আগুন সবকিছু কেড়ে নিয়েছে।’

এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল বিকেলে বালুখালীতে পুড়ে যাওয়া শিবির পরিদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে পোশাক বিতরণ করেন। র‍্যাব-১৫–এ অনুষ্ঠান আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন।

তিন বছর আগে নিজ দেশে অত্যাচার-নির্যাতনের মুখে ঘরবাড়ি ও জমিজমা ফেলে এখানে পালিয়ে এসে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসতি করে কোনো রকমের দিন যাপন করছিলাম। এখন আগুন সবকিছু কেড়ে নিয়েছে।
হামিদা বেগম, বালুখালীর রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা

দুই বছরে ৬টি অগ্নিকাণ্ড

২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবিরে ছোট-বড় ছয়টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। তবে এবারই প্রথম প্রাণহানি ঘটেছে। আগের সব ঘটনায় গ্যাস সিলিন্ডার বা রান্নাঘর থেকে আগুনের সূত্রপাত হলেও সোমবারের ঘটনা পরিকল্পিত বলে দাবি করছে রোহিঙ্গারা।

দুই বছরে ছয়টি অগ্নিকাণ্ড হলেও কোনোটিরই তদন্ত হয়নি। তবে সর্বশেষ আগুন লাগার ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা বলেন, এবারই প্রথম তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির এখন কাজ করছে।

রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কক্সবাজার ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক তারিকুল ইসলাম বলেন, অগ্নিকাণ্ডের পর সন্দেহভাজন সাতজনকে শিবির থেকে আটক করে পুলিশে দেওয়া হয়েছে।

আশ্রয়শিবিরে আগুন–আতঙ্ক

সোমবারের অগ্নিকাণ্ডে আশ্রয়শিবিরগুলোতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে বলে জানান রোহিঙ্গারা। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন থেকে পালিয়ে কক্সবাজারের ৩৪টি শিবিরে আশ্রয় নেওয়া নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১১ লাখ। এর মধ্যে উখিয়ার ২৩ আশ্রয়শিবিরে ৯ লাখের মতো রোহিঙ্গা বসবাস করছে।

উখিয়া ফায়ার সার্ভিসের লিডার এমদাদুল হক বলেন, এর আগে অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ড গ্যাস সিলিন্ডার ও রান্নাঘর থেকে হয়েছিল। শিবিরে আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যাওয়ার মতো রাস্তা ও পানির তেমন ব্যবস্থা নেই। ঘরগুলো গাদাগাদি করে তৈরি হওয়ায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আগের কোনো অগ্নিকাণ্ডে লোকজন মারা না গেলেও এবার শিশু, নারী, পুরুষসহ ১১ জন মারা গেছেন। এতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।